ফারহার সন্ধ্যা

৬ জুন, ২০২৩
আজকের সন্ধ্যেটা কি একটু বেশি নীল ছিল?

হয়তোবা।

সারাদিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হওয়ার পর সন্ধ্যেটা একটু বেশি সুন্দর দেখাবে—এটা অস্বাভাবিক কিছু না। শেষবিকেলে নিজের ঘরে ঢুকে নিজেই মুগ্ধ হলাম। খোলা জানালা দিয়ে নীল আলো আসছে, সারা ঘর ভেসে যাচ্ছে সেই আলোয়। ধবধবে বিছানার চাদর বাতাসে উড়ছে—এত সুন্দর একটা দৃশ্য!

অবশ্য মন খারাপ হতেও খুব বেশি সময় লাগলো না। এমন সুন্দর একটা সন্ধ্যা, অথচ ভাইয়া দেখবে না।

ভাইয়া যেদিন মারা যায়, সেই সন্ধ্যেটা আরও গাঢ় নীল ছিল। ময়মনসিংহ শহরটা ভেসে যাচ্ছিল বৃষ্টিতে। আর আমি চুপ করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মাথা ঝিমঝিম করছিল, বেশ বুঝতে পারছিলাম জ্বর আসছে। তবু জানালা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না।

আমি তখন ক্লাস টেনে। আর ভাইয়া পড়ত বুয়েটে থার্ড ইয়ারে। ভার্সিটিতে ওঠার পর প্রথম যেদিন ময়মনসিংহ ছেড়ে যায় ভাইয়া, আমাকে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘এই যে যাচ্ছি, বছর শেষ হওয়ার আগে আর আসবো না।’ তাই শুনে আমার সে কী কান্না! ভাইয়া বরাবরের মতই আমাকে পাত্তা না দিয়ে বের হয়ে গেল। আমি রাগ করে সেদিন ভাত খেলাম না। রাতে সে ফোন দিলো, আমি কথাও বললাম না।

ওমা, সপ্তাহখানেক পরেই এক দুপুরে দরজায় ঠকঠক শব্দ, দরজা খুলে দেখি ভাইয়া! ঘরে ঢুকেই আমার গাল টেনে বলল, ‘হাউ মাউ খাউ, এখনো মন খারাপ করে আছিস? এই নে—’, বলেই একটা ভারী প্যাকেট ধরিয়ে দিলো হাতে। খুলে দেখি, তিন খণ্ডে সুকুমার সমগ্র।

আমি কেবল চিৎকার দিতে বাকি রেখেছিলাম!

প্রতিবারই ভার্সিটি যাবার সময় ‘আর আসবো না’ বলে আমাকে খেপানোর চেষ্টা করত ভাইয়া। আমি রেগে আগুন হওয়ার ভঙ্গি করতাম। আর সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বের হয়ে চলে যেত।

তবে, থার্ড ইয়ারে ওঠার পর ভাইয়ার কী যেন হয়েছিল। বাসা এলে প্রায়ই আনমনা হয়ে থাকতো। মাঝেমধ্যে ছাদে উঠে চুপ করে বসে থাকতো। কী যেন লিখতো ডায়েরি খুলে। ঢাকায় গিয়ে কী করত কে জানে। আমি ফোন দিতাম, বেশিরভাগ সময়েই ধরত না। একদিন আমিই বাসায় কাউকে না জানিয়ে ঢাকায় চলে গেলাম। স্কুল ফাঁকি দিয়ে। সোজা ভাইয়ার ভার্সিটিতে গিয়ে হাজির হলাম, সামনাসামনিই জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার কী হয়েছে?’ শুনে সে হেসে ফেলল। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হা হা করে কিছুক্ষণ হেসে বলল, ‘আমার আবার কী হবে?’ সেই হাসি শুনে আমিও আর কিছু বলার পেলাম না। কেবল মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম, ‘ঢাকা এসেছি শুনলে আব্বু বকবে খুব এখন। ব্যবস্থা করে দাও।’

কেউ মারা গেলে আমার সেটা বিশ্বাস হয় না। মনে হয়, মানুষটা যেন আশেপাশেই আছে। যেই গতকালও ছিল সে আজকে থাকবে না—এটা মেনে নিতে পারি না হয়তোবা। দাদাভাই মারা যাবার পর আমার খুবই আশ্চর্য লেগেছিল—মানুষটার সাথে আর কথা বলতে পারবো না ভেবে।

অথচ আমাকে কেউ বলেনি, কিন্তু একসিডেন্টের পর আমার বিশ্বাস হয়েছিল ভাইয়া মারা যাবে। সেই বয়সে কেন এমন মনে হয়েছিল, কে জানে? ছয় বছর আগের অনেক স্মৃতিই মনে পড়ে না এখন, কিন্তু সেই সন্ধ্যাটার প্রতিটা ঘটনা আমার মনে আছে।

ভাইয়াকে যখন মেডিকেল কলেজে আনা হয়, বাসার সবাই সেখানে ছিল। শুধু আমি ছিলাম না। বৃষ্টিতে ভিজলে ঠাণ্ডা লাগবে দেখে মা যেতে দেয়নি। এরপর যখন হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নেয়া হয়, তখনও আম্মুকে অনেকবার বলেছি, আমি ঢাকায় আসি। মা আসতে দেয়নি।

রাতে ভাইয়াকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানোর আগে আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি কাঁদছিলাম দেখে কথা বলিনি। ভাইয়া মারা যায় পরদিন সন্ধ্যার দিকে। ওর কোমরের সবগুলো ধমনী ছিঁড়ে গিয়েছিল, হাড় ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো। খুব কষ্টেই মারা গিয়েছে। মারা যাওয়ার আগে মা তার হাত ধরে বসে ছিল। ভাইয়ার পাল্‌স বেড়ে গিয়েছিল।

ছয় বছর পর, আমার বয়স ভাইয়ার সমান হওয়ার কারণেই কিনা কে জানে, ছয় বছর আগের ঘটনাটা মনে পড়লে কিছুটা নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকি। স্কুলে থাকতে প্রায়ই ভেউ ভেউ করে কাঁদতাম, সেই বয়সটা বোধহয় পার করে এসেছি।

কিন্তু…ভাইয়াটা না গেলেও পারতো অবশ্য।

এত সুন্দর একটা সন্ধ্যা, অথচ সে দেখবে না।

ফারহা,
রোকেয়া হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[মূল গল্পের কিছুটা অংশ সত্য কাহিনী অবলম্বনে লেখা। দুটো প্যারা হুবহু তুলে দিয়েছি কারো একটা মন্তব্য থেকে, এবং তার অনুমতি ছাড়াই। ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।]