ক্ষুদ্র পুরাতন প্রশ্ন

জর্জ হ্যারিসনের একটা গান ছিল, হোয়াট আই ফিল, আই ক্যান্ট সেই। (জর্জ ছেলেটা না, বেড়ে গাইতো। একদিন ওকে নিয়ে লেখার ইচ্ছা আছে।)

আজকাল এই অনুভূতিটা প্রায়শই হচ্ছে আমার। হোয়াট আই ফিল, আই ক্যান্ট সেই। এই মাস দেড়েক আগেও, এক রাতে আকিব ছেলেটা বিশাল বিশাল মেসেজ দিচ্ছিল। সে কী ভাষা, একেকটা মেসেজের মধ্যে নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে শুরু করে বাংলাদেশে ইতিহাসে সমাজতন্ত্রের ভূমিকা পর্যন্ত সবকিছুই লিখে ফেলছে। আমি পড়ে শেষ করতে পারি না, একটা শেষ করার আগেই আরেকটা বিশাল মেসেজ চলে আসে। (আজকাল ছেলেটা বুর্জোয়াদের স্বর্গভূমির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লিস্টেড হয়েছে দেখে বিপ্লবের স্বর্ণক্ষেত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘোরাফেরা করা মানুষদের পাত্তা দেয় না। তাতে খুব সমস্যা হয় না অবশ্য, কারণ আরামবাগ কিংবা ময়মনসিংহ হয়ে তার খবর আমার কাছে আসে।)

যাকগে, সে রাতে আকিবের দুঃখভরা কথাগুলো শুনে আমার আবারও একই অনুভূতি হচ্ছিল।

জীবনের অর্থ কী? আমাদের কাজগুলো শেষপর্যন্ত কোথায় পূর্ণতা পাচ্ছে? কিংবা, আদৌ কি পাচ্ছে?

প্রশ্নগুলো কি আরজ আলী সাহেবের মত হয়ে যাচ্ছে? হা হা! হয়তোবা। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই প্রশ্নগুলোই আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভাবায়। অন্তত যারা একটু-আধটু চিন্তা করে।

ফরেস্ট গাম্প মুভিটার কথা মনে আছে? আমি মুভি দেখি না তেমন একটা, কিন্তু ফরেস্ট বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। ছেলেটা যে বেঞ্চে বসে বিড়বিড় করে বলতে থাকতো, জীবনটা একটা বক্স অফ চকলেট—ছোটবেলায় কথাটার অর্থ বুঝতাম না। এখনো বুঝি না, কিন্তু কথাটা খুব বেশি করে ভাবায়। আসলেই কি জীবনটা একটা চকলেটের বাকসো? আমরা সারাজীবন খেলে যাবো, কখনো জিতলাম, কখনো হারলাম, আর একসময় কেবল মরে গেলাম—ওখানে একেবারেই ফুলস্টপ?

ধর্মে যেহেতু বিশ্বাস করি, মৃত্যুতে আমাদের ফুলস্টপ আসে না। প্রায় কোনো ধর্মেই মৃত্যুতে ফুলস্টপ দেয়া হয়নি। আমি যেমন বিশ্বাস করি, একদিন আল্লাহর সামনে গিয়ে হিসাব দিতে হবে, তেমনই বিন্দু বিশ্বাস করত আবারও এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে, পরের জন্মে। (মনে আছে ‘সেই সময়’ উপন্যাসে বিন্দুর সেই হাহাকার? ‘কেউ দিলে না, এই জন্মে আমাকে কেউ দিলে না! আসছে জন্মে যেন তোকে পাই’—বলেই যে পানিতে ঝাঁপ দিলো, স্পয়লার দেয়ার জন্য দুঃখিত, কিন্তু উপন্যাসের সেই অংশটুকু এত অসাধারণ ছিল, কী বলব।) বিন্দুর আশা এই ছিল যে, এই জন্মটা বৃথা গেল, কিন্তু সামনের জন্মে কিছু একটা হবে। আমাদের আশা, এই জন্মশেষে ভালো কিছু একটা পাব, পরকালে।

এই ‘আশা’-তেই কি আমরা বাঁচি? অন্তত আমাদের বয়সীরা? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরটা বোধহয় ‘না’। আমরা সম্ভবত খুব অল্প কিছুদূর দেখতে পাই। আমি এসএসসি কীভাবে পাশ করব, ভার্সিটিতে কোথায় চান্স পাব, চাকরি কোথায় করব।

কিন্তু…

“What is my life! I like to know
Tell me who am I without you?”

জর্জের এই প্রশ্নটা আমাকে শেষপর্যন্ত অনেক বেশি ভাবায়। who am I without you? এই ‘you’-তে এসেই ভালোবাসাটা একাকার হয়ে গেছে। এই ‘you’ কি সৃষ্টিকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বলা? নাকি কোনো মানুষকে? আমি জানি না। সম্ভবত জানার তেমন প্রয়োজনও নেই। রবীন্দ্রনাথের ‘এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে’-তে এসেও কি আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাই না? এই প্রেম কার প্রতি? জর্জ হ্যারিসনে এসেও একইভাবে আধ্যাত্মিক প্রেম আর মানবিক প্রেম একাকার হয়ে গেছে।

হঠাৎ করে আশ্চর্য লাগতেই পারে, আমাদের রবীন্দ্রের আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনা কীভাবে ষাটের দশকে জন্ম নেয়া একটা রক ব্যান্ডের গায়কের মাথায় ঢুকে গেল? সাদাসিধে রক ব্যান্ডও না, একেবারে বিটল্‌সের মত একটা ব্যান্ড, যারা ষাটের দশকে পুরো পৃথিবীকেই নাড়া দিয়ে ছেড়েছিল, যাদের কনসার্টে মেয়েরা হাত কামড়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদতো, মাত্র বাইশ বছর বয়সেই যারা ব্রিটেনের রানীর সামনে রসিকতা করার স্পর্ধা রাখতো!

অন্যদিক দিয়ে দেখলে, ব্যাপারটা প্রত্যাশিত ছিল। এবং এখানে বিশাল ভূমিকা ছিল একজন মানুষের—রবিশঙ্কর! মানুষটাকে জর্জ হ্যারিসন রীতিমত গুরুর মত ভক্তি করত। তার ভাষায়, রবিশঙ্কর ছিলেন একমাত্র মানুষ যিনি জর্জকে মুগ্ধ করতে পেরেছেন, এবং তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি জর্জকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করেননি!

রবিশঙ্করের সাথে পরিচয় হওয়ার পর আমাদের উপমহাদেশের সঙ্গীতের প্রতি, চিন্তাভাবনার প্রতি জর্জের আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। বিটল্‌সের শেষের দিকের গানগুলোতে এটা খুব ভালোমতই দেখা গেছে। আমার এখনো মনে আছে, ছোটবেলায় যখন প্রথম প্রথম বিটল্‌স শোনা শুরু করি, একদিন পুরো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল, ভারতীয় কোন বাদ্য শুনছি যেন! (ওটা সেতার ছিল। আমি মূর্খ তো, চট করে বুঝিনি।)

প্রসঙ্গের বাইরে চলে যাচ্ছি। আসলে যেটা নিয়ে কথা বলছিলাম, জীবনের অর্থ কী। হুম, জীবনের অর্থ হচ্ছে…মানে, আমি তো জানি না এটা। আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি আরকি।

আহা, জাত থাকে, জাত থাকে একটা। জাত থাকে মানুষের। আমি এমনই নীচ, জীবনের বিশটা বছর আমি টেরই পাইনি আকাশ বলে কিছু একটা আছে। এখন, ধীরে ধীরে যখন আলো দেখছি, আমি বারবার করে মুগ্ধ হচ্ছি। আমি বোঝার চেষ্টা করছি। জর্জের ভাষায়, what I feel, I can’t say, কিন্তু আমি বোঝার চেষ্টা করছি এই জীবনটাকে। আমি নিজেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি পুরো পৃথিবীকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি তসলিমাকে বোঝার চেষ্টা করছি—সে কী বলতে চায় আসলে? আমি গোর্কি নেড়েচেড়ে দেখছি—তার একটা লেখা কীভাবে সারা পৃথিবীকে ধাক্কা দিল? আমি কোরান শরীফের বঙ্গানুবাদ আশ্চর্য হয়ে পড়ছি, আহা, এই কথাগুলো বোঝার জন্যও তো আমাকে প্রচুর পড়তে হবে…

আর আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি, কেন আমাকে কয়েকজন ভালোবাসে। এ তো বিশাল একটা আশ্চর্য, আমাকে তো ভালোবাসার কিছু নাই। আমি একেবারে সাধারণ একটা ছেলে। আমার রেজাল্ট সাধারণ, আমার কথাবার্তা সাধারণ। আমি আকিবদের মত ফিজিক্স পারি না। আমি নদীর মত গিটার বাজাতে পারি না। আমি আহমাদের মত লিখতে পারি না। আমি ভাত খাই। সত্যি, আমি ডাল দিয়ে ভাত মেখে হাত দিয়ে খাই। এরপরেও আমাকে কয়েকজন ভালোবাসে, কেন ভালোবাসে? 

আমার উত্তরগুলো দরকার, খুব দরকার।

আমি এখানে কী করছি, আমার জানা দরকার।