আগুনের পরশমণি

আমার ধারণা, পৃথিবীর প্রতিটা মহৎ কাজের জন্ম হয় গভীর দুঃখ থেকে।

বছরদুয়েক আগে এই শহরটা ভুতুড়ে একটা সময় পার করছিল। রাজনীতির সবচেয়ে অন্ধকার অংশটুকু সেই সময় প্রথমবারের মত আমাকে সামনাসামনি দেখতে হয়েছে। মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি তখন। ক্লাস শুরু হয়নি, কাজেই হাতে কাজকর্ম নেই। প্রচুর গান শুনতাম। আর দিনরাত ছবি আঁকতাম। প্রায় প্রতিদিনই মেসালদের সাথে আড্ডা দিতাম। আর প্রায় প্রতিদিনই এই শহরের মানুষেরা পুড়ে মরত। মানুষ বড় সস্তা ছিল তখন, চাইলেই একসাথে দু-দশজনকে পুড়িয়ে মারা যেত। আমার বয়সী একটা ছেলে একদিন তার বাবার ট্রাকে বসে ছিল। ঘুমাচ্ছিল। সেই বাসে আগুন দেয়া হল, ছেলেটার পঁচানব্বই ভাগ পুড়ে শেষ। সেই অবস্থায় সে দুদিন বাঁচলোও। কী কষ্ট! পোড়ার যে কষ্ট—সেটা যার কখনো হয়নি তার জন্য বোঝা কঠিন।

(এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই ব্যাপারটা কিছুটা লিখেছিলেন নোবেলজয়ী স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ, তাঁর ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল বইটাতে। চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর আশেপাশের অনেক লোক রেডিয়েশনে পুড়ে গিয়েছিল, মানুষগুলো কীভাবে হাসপাতালে ধীরে ধীরে মরে গেল—সেই ভয়ংকর কষ্টের বর্ণনা বইটাতে আছে। আমি যখন দিনাজপুরের সামার ক্যাম্পে ছিলাম, ক্লাসের মাঝে এই ঘটনাগুলো বলছিলাম। একসময় পিচ্চিগুলো গালে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে ফোঁস ফোঁস শব্দে নিশ্বাস ফেলতে শুরু করল, তখন আমাকে বাধ্য হয়েই গল্পটা থামাতে হল। সব ক্যাম্পে কাঁদার সুযোগ তৈরি করে দিতে নেই।)

যাই হোক, যা বলছিলাম। পনেরো সালের সেই সময়টাতে আমরা বাসে চড়তাম না। পেট্রোলবোমার ভয়ে। রিকশায় চড়ে যে রেহাই ছিল—এমনও না—একদিন চোখের সামনে ককটেল ফেটে একটা লোক রক্তে ভেসে গেল। আমি আর মেসাল হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম, আমাদের রিকশাটা আরেকটু সামনে থাকলে সেই লোকের জায়গাটা আমাদের হত।

ওহ…মৃত্যু, এত মৃত্যু সেই বয়সে আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বন্যায় মানুষ মারা যেতে পারে, ঝড়ে মারা যেতে পারে, কিন্তু প্রত্যেকটা দিন মানুষের হাতেই মানুষ কীভাবে মরে? তুচ্ছ ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে এত মৃত্যু—সেটাই বা কীভাবে মানা যায়?

সেই সময়টা বারবার করে ডিলানের কথাগুলো মনে পড়ত। হাউ মেনি ডেথ্‌স উইল ইট টেইক টু রিয়ালাইজ, দ্যাট টু মেনি পিপ্‌ল হ্যাভ ডাইড? কতগুলো মৃত্যু হলে বোঝা যাবে যে যথেষ্ট হয়েছে?

আহা, ডিলান নিজেও কি গভীর দুঃখ থেকেই এই কথাগুলো লেখেননি? নিশ্চয়ই লিখেছেন।

শাহবাগের মোড় অবরোধ করে যারা স্লোগান দেয়—তারাই বা কেন দুপুররোদ মাথায় করে এই কাজগুলো করে? এটা অবশ্য বলা একটু কঠিন, কারণ ‘মিছিলের সব হাত, কণ্ঠ, পা এক নয়’, তবু ব্যক্তিগত কারণটা বলতে পারি—দুঃখ। হয়তোবা সবার জীবনেই এই সময়টা আসে, পত্রিকাটা হাতে নিলে প্রচণ্ড কষ্ট লাগে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতেও ঘৃণাবোধ হয়—এখনো তো হাড়গুলো ক্ষয়ে যায়নি! হয়তো সেই কষ্টেই মানুষ শাহবাগের মোড়ে বসে থাকে। যারা আরও বেশি ‘মানুষ’, তারা জলকামানের আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়েও হুংকার দেয়। (অবশ্য, যারা আরও মানুষ তারা ট্যাঙ্কের বহরের সামনে দাঁড়িয়ে পুরো বাহিনীকেই আটকে দেয়। মাইরি, এই লোকটাকে খুঁজে পেল না আর কেউ, যদ্দূর জানি।)

কিন্তু…সেই লোকটার গল্পও কি একই ছিল না? পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ কি ট্যাঙ্কের সামনে বুক পেতে দেয়? মনে হয় না।

আর রুমী! মানে, ঐটুকু বয়সে সবাই চলে গেল যুদ্ধে, সুফিয়া কামালের মেয়েরা, উনিশ-বিশ বছর বয়স, ওদিকে রুমীদের দলটা—সবাই সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে গেল। অবশ্যই গভীর দুঃখ থেকে।

আচ্ছা, জাদুঘরে নাকি জয়নুলের আঁকা অনেকগুলো ছবি এখনো রাখা আছে? সংখ্যাটা নাকি শ’য়েরও বেশি? আমি দেখিনি কখনো। দেখতে দেয়? আমার খুব ইচ্ছে, একদিন দেখবো। জয়নুলের ছবি…সেই দুর্ভিক্ষ…ওনার গল্পটাও সম্ভবত আলাদা না।

আহা, রবীন্দ্রনাথ কি এজন্যই বলতেন, ‘এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে’? ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব পানে, ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব পানে…হয়তো এই আগুনে পুড়েই আমাদের শুদ্ধ হতে হবে…