Eleanor Rigby

আজকের রাতটা তাৎপর্যপূর্ণ একটা রাত।

শেষ রাতের বৃষ্টিতে আমার শহরটা ভেসে যাচ্ছে। অথচ গতকাল ঠিক এই সময়ে বৃষ্টির কণামাত্রও ছিল না। আকাশজুড়ে খুব হালকা একটা আলো ছিল। কৃষ্ণা পঞ্চমীর চাঁদ কি অতক্ষণ থাকে? জানি না, কিন্তু একটা যে আলো ছিল—সেটা তো মিথ্যে না, আর সেই আলোয় আলাদা করে মেঘগুলো দেখা যাচ্ছিল। এত পবিত্র একটা দৃশ্য!

গতকাল রাতে ঘুমোতে গিয়েছিলাম একটা মুগ্ধতা নিয়ে। কারণ কিছুক্ষণ আগে আমি একজন অসাধারণ মানুষকে আবিষ্কার করেছি। এমনিই নেটে ঘোরাঘুরি করছিলাম, হঠাৎ করেই আমার মনে হল, সে অদ্ভুত ভালো একজন মানুষ। চেনাজানা মানুষের ভেতর থেকে যখন অসাধারণ একজন বের হয়ে আসে—এর চেয়ে অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার আর কী হতে পারে? নাকি আমাদের ম্যাথ অলিম্পিয়াড করা ছেলেমেয়েগুলো—ওরা কি এমনিতেই এত চমৎকার একেকজন মানুষ হয়? কে জানে!

কিন্তু আজকের রাতটা গতকালকেও ছাড়িয়ে যাবে দেখছি। শুরু হয়েছিল খুবই সাধারণভাবে। কাজ করছিলাম, এমন সময় তটিনী ফোন দিল। মানুষজনের যে বকা খাওয়ার এত আগ্রহ থাকতে পারে—সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। টাকা খরচ করে কেন মেয়েটা বকা খায়, কে জানে।

কিন্তু কোন কোন দিন একটু অন্যরকম হতে বাধ্য। আমার ধারণা, আমি অসাধারণ একটা বকা দিলাম। ব্যাপারটা হাস্যকর, কারণ বকা কখনো ‘অসাধারণ’ হয় না। কিন্তু তবু, আজ দীর্ঘ সময় ধরে যেই বকাটুকু দিলাম, সেটা দিয়ে আমি পবিত্র এবং আধ্যাত্মিক একটা আনন্দ পেয়েছি।

এই শান্তিটুকু একটু পরেই বিস্ময়ে পরিণত হল, যখন আমার ফোনে দীর্ঘ একটা মেসেজ আসলো। পুরনো একজন মানুষের কাছ থেকে। তামান্নার চেয়েও পুরনো যেই মানুষটা, তার কাছ থেকে। আমি আশ্চর্য হয়ে বসে থাকলাম, পৃথিবীতে এখনো এত ভালো মানুষ আছে? এবং আমার আশেপাশেই এরা আছে?

আশ্চর্যের ভাবটা কাটার আগেই আরিফের মেইল আসলো, ‘কষ্টে আছি আইজুদ্দীন’। আমি কোনমতে হাসি আটকানোর চেষ্টা করতে করতে ছেলেটাকে ফোন দিলাম। আমার সেকেন্ডে এক পয়সার অফারটা বড় ক্ষতি করে ফেলছে, ইচ্ছেমত মানুষের সাথে ফোনে আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছি।

আরিফের সাথে আড্ডাটা যখন পঞ্চাশতম মিনিটে গড়িয়েছে, সেই মুহূর্তে বৃষ্টিটা প্রচণ্ড জোরে পড়তে শুরু করেছে। আমি ছেলেটাকে বললাম, এখন বাঁশি বাজাস না আর? এইসব রাতে?

আহা, সেই রাতগুলো, প্রচণ্ড ঝড়ের পর বিদ্যুৎ চলে গেছে, চারপাশের সব বাড়ি অন্ধকার, আর আমি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে টুংটাং করতে করতে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, ক্রমাগত wish you were here বাজিয়ে যাচ্ছি—সেই রাতগুলোর তুলনা হয়?

আরিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে ফেলল। বলল, ‘আপনি যদি গতকাল আরামবাগের সুয়ারেজ-পানিতে হেঁটে বেড়াতেন, মনে হয় বৃষ্টিটা এভাবে উপভোগ করতে পারতেন না। আর মানুষজন, এত মানুষ রাস্তায় শুয়ে আছে।’

আরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমিও হালকা গলায় হাসলাম। Eleanor Rigby, where do they all come from?

আরিফকে যেটা সত্যি সেটাই বললাম। আনন্দ এবং দুঃখগুলো পাশাপাশি চলতে থাকে। বৃষ্টিতে আমি শুকনো আছি, আমি উপভোগ করছি। এটা সুখ। আবার এই বৃষ্টিতেই কেউ কেউ সুখে নেই। রাঙামাটির কথাই ধর। ওরা সুখে নেই। ছেলে, মেয়ে, মা এবং স্ত্রীকে একসাথে হারালে কী পরিমাণ কষ্ট হয়—সেটা আমরা কীভাবে বুঝবো?

এরপরেও আমরা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখাই। কিন্তু, সুখের স্বপ্নগুলো সবাইকে দেখালেও, দুঃখের ব্যাপারটা সবার সাথে ভাগাভাগি করা যায় না। ইন্টারস্টেলার মুভিতে একটা কথা ছিল, তুমি এমন কিছু করতে পারো না যেটাতে তোমার বাচ্চাটা সেইফ ফিল করবে না। আমার ছোটবেলায় এমন একটা ঘটনা ছিল। একদিন খুব ভূমিকম্প হয়েছে। আমি ভয়ে রাতে ঘুমোতে পারছি না। তখন আব্বু আমাকে বলল, ‘চিন্তার কিছু নাই, অন্য সব বাড়ি ভেঙে পড়লেও আমাদেরটা ভাঙবে না।’ আমি তখন অনেক ছোট, কাজেই আব্বুর মিথ্যেটুকু ধরতে পারলাম না। এবং সে রাতে আমি আসলেই শান্তিতে ঘুমালাম। এখন বুঝি, সেই সময়টুকু আব্বু কীভাবে আগলে রাখতো।

আমার মনে হচ্ছে, আরিফরা ‘আগলে থাকার’ বয়সটা ধীরে ধীরে পার করে আসছে। এত জোস এই মানুষগুলো! ওদের সামনে হয়তো একদিন সমানে সমানে কথা বলা শুরু করব, ষোড়শ বর্ষে পুত্র মিত্র বদাচরেৎ!


পরিশিষ্ট: বিটল্‌সের প্রায় সব গানই অন্তর্জাল থেকে সরিয়ে ফেলায় আজকাল মানুষকে এই ব্যান্ডের কথা বলতেই ভয় লাগে। ঘাঁটাঘাঁটি করলে ‘বিটল্‌স’ নামে যেসব বের হয় তার অধিকাংশই সস্তা কাভার। জর্জের মায়াবী গলার সাথে এসবের কোন তুলনা হয়? জন লেনন যেভাবে রক গাইতো, সেই সুরে কি আর কেউ গাইতে পারে?

তবে, যেই দু-একটা গান এখনো পাওয়া যায়, তার মধ্যে eleanor rigby অন্যতম। এই লিংকে ক্লিক করে শুনে দেখতে পারো/পারিস। যদি আরও অনেক অনেক বিটল্‌স শুনতে চাস, আমার কাছে এক ঝুড়ি গান আছে। নিয়ে নিস।