অবোধ


এক.

আমাদের পাশের বাসায় গতকাল একজন মারা গেছেন।

দীর্ঘ উনিশ বছর ধরে একই এলাকায় আছি তো, অনেকগুলো জন্ম-মৃত্যু দেখতে হয়েছে আমাকে।

আমার কেন যেন একটাও বিশ্বাস হয় না। এই ধরো, আপুর ঘর থেকে কোণাকুণি যে বাসাটা দেখা যায়—সেখানে একটা ছেলে থাকতো। সিক্স-সেভেনে পড়ে হয়তোবা। সারাদিন দৌঁড়াতো। আর ওর ছোট বোনটার সাথে দুষ্টুমি করতো। ওদের খিলখিল হাসি আমাদের বাসা থেকেও শোনা যেত। মন খারাপ থাকলে প্রায়ই আপুর ঘরের জানালা দিয়ে আকাশ দেখতাম, তখন ওদের দিকেও চোখ পড়ত। (উল্লেখ্য, আমার জানালা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়। আপুর জানালা দিয়ে দেখা যায় অনেকখানি। ছোটবেলায় আপুর ঘরের প্রতি আমার আলাদা একটা ভালোবাসা ছিল। সেটা জানালার জন্যও হতে পারে, আপুর আদরের জন্যও হতে পারে—কে জানে।)

একদিন পাশের বাসার সেই ছেলেটা মারা গেল। হঠাৎ একিউট লিউকেমিয়া ধরা পড়ল, ঠিকঠাক চিকিৎসা শুরু করার আগেই সব শেষ। ব্যাপারটা আমি জানলাম কলেজে যাওয়ার সময়। সকালবেলা বাসা থেকে বের হয়েছি, এমন সময় হাউজিং-এর মাইকে ঘোষণা করা হল, ছেলেটা মারা গেছে।

ওর ছোট বোনটা প্রায়ই বারান্দার জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতো। চুপ করে। সেও দেখত দেখতে বড় হয়ে গেল। ছেলেটার বয়স ওখানেই শেষ, তার ছোট বোনটা ঠিকই তাকে ছাড়িয়ে গেল।

আমাদের ঠিক পাশের ফ্ল্যাটের পুরো জেনারেশনটাই একে একে মারা গেছে। আমি খুব ছোট তখন, আন্টি যেদিন মারা গেলেন—তার আগের রাতে ওরা আম্মুকে ডেকে নিয়েছিল। আন্টিকে দেখে এসেই আম্মু বলল, অবস্থা খুব খারাপ, এখনই হাসপাতালে নিতে হবে। ওরা কেন যেন শুনলো না। সারারাত আন্টিকে বাসাতেই রাখলো। আম্মু গিয়ে আন্টিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনার কি কষ্ট হচ্ছে?’ আন্টি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘না কোনো কষ্ট নাই।’ আম্মু বারবার করে ওদেরকে বলল, তখনই হাসপাতালে নিতে, আন্টির অবস্থা খুব খারাপ। ওরা নিলো না। শুধু ভোররাতে আম্মুকে আরেকবার ডেকে পাঠালো। মা গিয়ে দেখে, সব শেষ।

এবং আশ্চর্য, আন্টি মারা যাবার ছয় মাস পর আংকেলও ঠিক একইভাবে চলে গেলেন। সেই মাসছয়েক উনি একেবারে চুপচাপ ছিলেন। তেমন কথাবার্তা বলতেন না। আম্মু সিঁড়িতে দেখা হলে আলাপ জমানোর চেষ্টা করত, উনি হ্যাঁ-হুঁ করে চলে যেতেন। এক ভোরে ওনার ছেলেমেয়েরা আম্মুকে আবারও ডাক দিলো। এবং একইভাবে আম্মু গিয়ে দেখলো, আংকেল মারা গেছেন।

এবং ওদের বাসাতেও, জীবন থেমে থাকলো না। ওনাদের অনেকগুলো ছেলেমেয়ে ছিল, তাদের একজন উঠে আসলো সেই বাসায়। সুমন ভাইয়া। হিসেবমত ওনার স্ত্রী স্বপ্না আমার ভাবী হবে, আর ওনার তিন মেয়ের আমি চাচা হব। কিন্তু ওদের পাঁচজনের কেউই সেই ঝামেলায় গেল না, সবাই মিলে আমাকে ‘ভাইয়া’ ডাকা শুরু করে দিলো।

আর আমাদের ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিল যেই মেয়েটা…আমাদের চোখের সামনে…

দুই.

কিন্তু না, এই কথাগুলো বলার জন্য তো লিখতে বসিনি…

এই যে, এত মৃত্যু, এগুলো কি আমাদের আরো একবার ভাবতে বাধ্য করে? আমি কে, কেন উনিশশো পঁচানব্বই সালের চৌদ্দই সেপ্টেম্বর এসে এখানে হাজির হলাম—এই কারণগুলো খুঁজতে ইচ্ছে করে না মাঝেমধ্যে?

আমি উত্তর খুঁজে পাই না…

তিন.

মনে হয়, এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো।

আমি খুঁজি, প্রাণপণে নিজেকে খুঁজি। একটু বড় হওয়ার পর আমার সবসময়ই মনে হয়েছে, প্রচুর পড়তে হবে নিজেকে চেনার জন্য। পৃথিবীর সবকিছুই পড়ে ফেলতে হবে। সেই মুহূর্তে, মাসকয়েক আগে আমি ফেসবুকটা বন্ধ করে দিলাম, ঠিক করলাম, মানুষ হব। চোখের সামনে যা পেলাম, পড়ে ফেলতে শুরু করলাম…

কিন্তু…খেলা এখনো অনেক বাকি…

কেবল নিজেকে না, চারপাশের মানুষগুলোকেও আমি খুঁজে ফিরি। নিজেকে যেমন চিনি না, সময়ে সময়ে মনে হয়, চারপাশের কাউকেই চিনি না। আমাকে কয়েকটা মানুষ অসম্ভব ভালোবাসে—তাতেও আমার ভয় হয়। ভয় হয়, কারণ আমি ভালোবাসার কারণটা খুঁজে পাই না…আর ঠিক এখানেই আমার ট্রাম্প কার্ডটা শেষ হয়ে যায়…ভালোবাসাগুলো ভণ্ডামো মনে হয়…মিথ্যে মনে হয়…

এইসব মুহূর্তে আমি একশো হাত পানির নিচে ডুব দেই। পারলে সবার কাছ থেকেই পালিয়ে থাকি। যেকোন মানুষের মুখোমুখি হতে আমার অসম্ভব আতঙ্ক হয়, কারণ আমি তাকে চিনি না…

Oh lord, it takes so long, my lord…