ছাদ


এক.

ফারহাদের বাসাটা তিনতলা।

একতলাটা গত দু মাস ধরে ফাঁকা পড়ে আছে।

আর দোতলায় গত বিশ বছর ধরে এক বুড়ো পড়ে আছে। রিটায়ার্ড বুড়ো। বিশ বছর আগে লোকটা যখন এই বাড়িতে উঠেছিল, তখনও নাকি এমনই বুড়ো-বুড়ো চেহারা ছিল। একহাতে ছেঁড়া সুটকেস, আর অন্য হাতে একটা ভাঙা গীটার নিয়ে উঠে এসেছিল এই বাড়িতে।

তবে আশ্চর্য এই যে, গত বিশ বছরে কেউ এই বুড়োকে গীটার বাজাতে শোনেনি। বুড়ো চিৎকার করে বাড়িওয়ালার সাথে ঝগড়া করেছে, এলাকার ছোট বাচ্চাদের আদর করে চকলেট খাইয়েছে, রমজান মাসে সারারাত মসজিদে জেগে কেঁদেছে, শেষবিকেলে বাসার চারপাশে পায়চারী করেছে, কিন্তু কখনই তার গীটারটা বাজায়নি। অথবা, কেউ তাকে বাজাতে শোনেনি।

ফারহার আম্মুর ধারণা, বুড়ো গীটার বাজাতে পারে না। কোথাও কুড়িয়ে পেয়েছে—তাই নিয়ে চলে এসেছে। চালচুলোহীন বুড়ো!

ফারহার কেন যেন এটা বিশ্বাস হয় না। বুড়ো বড্ড গরীব—এটা ঠিক অবশ্য। তাই বলে খামোখা একটা ভাঙা গীটার নিয়ে বিশ বছর পার করে দিবে? সে মাঝেমধ্যেই ভাবে, একদিন সাহস করে বুড়োকে জিজ্ঞেস করবে, উনি গীটার বাজান না কেন। সাহস হয়ে ওঠে না।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় কখনো বুড়োর সাথে দেখা হয়ে যায়। বুড়ো গম্ভীর মুখে হুংকার দেয়, ‘কেমন আছিস?’ ফারহা কোনোমতে ‘ভালো আছি’ বলেই দৌঁড়ে চলে আসে। বুড়োকে যে ঠিক ভয় পায় ফারহা—ব্যাপারটা এমন না। তবে লোকটার গলা থেকে রীতিমত মাইকের শব্দ বের হয়। একতলায় দাঁড়িয়ে কথা বললে সেই কথা চৌরাস্তা থেকেও শোনা যায়। এমন ভয়াবহ গলা যেই লোকটার—তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে অস্বস্তি লাগলে দোষ দেয়া যায় না। এমনকি, ফারহার বাবাও বুড়োর সামনে দাঁড়িয়ে একটু উসখুস করেন। দু মিনিট কথা বলার পরেই ঢোঁক গিলে বলেন, আচ্ছা চাচা, আজ আসি?

তিনতলা বাসাটার সবচেয়ে ওপরে থাকে ফারহারা। ছোট্ট একটা বাসা। বাসাটার আলাদা কোনো বর্ণনা দেয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ ঢাকা শহরের যেকোনো মধ্যবিত্ত পরিবার ঠিক এমন বাসাতেই থাকে। একটা টেবিল। পাশে ছটা চেয়ার। খাবার ঘরের সাথে লাগানো রান্নাঘর। বসার ঘরটা একটু গোছানো, তবু কেন যেন অগোছালো হয়ে থাকে। বারান্দায় ঝুলে থাকে ভিজে জামা। আর দশটা বাড়ির সাথে কোনো পার্থক্য নেই।

তবে, আর দশটা বাড়িতে থাকে না—এমন একটা জিনিস এ বাড়িতে আছে। বাড়ির ছাদে ছোট্ট একটা ঘর। ও ঘরটা ফারহার নিজের।

ছাদের সেই ঘরটাকে আলাদা একটা রাজ্য বলা যায়। গাদা গাদা বই, ছবি আঁকার পেনসিল, খাতা—সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে সারাক্ষণ। আম্মু প্রতিদিন একবার করে এসে চেঁচামেচি করে যায় ঘরটা গোছানোর জন্য। ফারহা অনেকটা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতেই বলে, ‘হুম গোছাবো!’ সেই বলা পর্যন্তই। গোছানো আর হয়ে ওঠে না।

ফারহার একটা সিক্রেট আছে। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে যায়, সে লুকিয়ে কবিতা পড়ার চেষ্টা করে। রাত্তিরে কেউ তার ঘরে আসে না। যদি আসতো, তবে ফারহার স্পষ্ট গলায় শুনতে পেত,

“গেইলি বিডাইট
আ গ্যালেন্ট নাইট
ইন সানশাইন এ্যান্ড ইন শ্যাডো
হ্যাড জার্নিড লং
সিঙ্গিং আ সং
ইন সার্চ অফ এলডোরাডো।

তবে তার আবৃত্তি কিছুতেই রিয়ার মত হয় না। এটা একটা সমস্যা।

তার চেয়েও বড় সমস্যা, রিয়া যখন এ বাসায় আসে তখন অমলদাকে সাথে নিয়ে আসে। থুড়ি, আসলে অমলদাই রিয়াকে নিয়ে আসে। রিয়ার এই একটাই ভাই। ফারহা আর রিয়া যখন ঘরে বকবক করে তখন বাবা আর অমলদা ছাদের এক কোণে চেয়ার টেনে বসেন। সেখানে দুজন মিলে গম্ভীরমুখে কীসব আলোচনা করতে থাকেন। এসময় তাদেরকে দু-তিন দফা চা বানিয়ে দিতে হয়। এত রাগ লাগে ফারহার! কে বলেছে বাপু তোমাদের বসে বসে লেনিন-স্তালিনের নাম আওড়াতে? ফারহার খুব ইচ্ছে, একদিন অমলদার মাথায় একটা চায়ের কাপ ভাঙবে। ভাঙবেই ভাঙবে।

ভার্সিটিতে ওঠার পর অমলদার খুব ইয়ে হয়েছে আজকাল। ফারহা একদিন রিয়ার সাথে আবৃত্তি করার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ খেয়াল করল, দরজায় অমলদা দাঁড়িয়ে আছে। মুখে মুচকি হাসি। হাসিটা চেপে রেখেই অমল রিয়াকে ডাকলো, ‘বাসায় চল্‌ গাধা। রাত হয়েছে।’ এরপর ফারহার দিকে একবারও না তাকিয়ে নিচে নেমে গেল।

সে রাতে ফারহার বেজায় রাগ হয়েছিল।

বলতে ভুলে গেছি, ফারহা আর রিয়া—দুজনেই পড়ে ক্লাস টেনে। আর্মানিটোলা গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে। ফারহার রোল এগারো। রিয়ার সাড়ে এগারো। বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার সময় স্যারদের হিসেবে একটু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। সেই ভুল ধরা পড়ার পর স্যার খুবই রাগ করেছিলেন। কাকে বকা দিবেন সেটা বুঝতে না পেরে খেপে গিয়ে রিয়াকে বলেছিলেন, ‘যা, তোর রোল আজ থেকে সাড়ে এগারো।’


দুই.

‘এই যে আপা! এই যে ইন্টারের বই এইদিকে, সিটি কলেজ, আপা কই যান আপা এইদিকে‼’

ফারহা অনেক কষ্টে হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করছে। নীলক্ষেতে ঢুকলে কেমন যেন সুড়সুড়ি লাগে—দোকানদাররা এমনভাবে বই বেচার চেষ্টা করে যেন এই মুহূর্তে বিক্রি না হলে তাদের ব্যাবসা বরবাদ হয়ে যাবে। প্রথম যেদিন সে এসেছিল সেদিন পুরো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিল। দোকানদাররা এমনভাবে ‘এই যে আপা’ বলে ডাকছে, যেন কতদিনের চেনা মানুষ! সে রীতিমত ‘জ্বী আংকেল, কী হয়েছে আংকেল’ বলে দোকানদারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। পরে বাবা শিখিয়েছে, নীলক্ষেতে ঢুকে এমন ভাব করতে হবে, যেন দোকানদাররা অদৃশ্য মানুষ। ওদেরকে দেখা যাচ্ছে না, এমনকি ওদের কথাও শোনা যাচ্ছে না। দুখী-দুখী একটা চেহারা করে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হবে।

সে অবশ্য এসেছে মোস্তফা চাচার দোকানে একবার ঢুঁ মেরে যেতে। স্কুলশেষে কখনই বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে না। কাজেই সে এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকে। যেসব দিন রিয়া সাথে থাকে, ভালো। নয়তো একাই ঘোরে। শহরের রাস্তায় হাঁটতে কেন যেন ভালো লাগে।

ফারহার তেমন কোনো তাড়াও নেই। মা-বাবা দুজনেই পাঁচটার পরে ফিরবেন, কাজেই বিকেল করে বাসায় গেলেও কেউ বকবে না। আর বকলেই বা কী! বকা খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে এখন, খুব একটা সমস্যা হয় না।

কিন্তু, সমস্যাটা আসলো অন্য দিক দিয়ে।

আজ ঘোরাঘুরিটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছিল, আজিমপুর কবরস্থানে যাবে। মুজতবা আলী সাহেবের কবরটা সেখানে কোনো এক জায়গায় আছে—ফারহার খুব ইচ্ছে, একদিন ওটা খুঁজে বের করবে। রিয়াকে বলেছিল সাথে যেতে। বোকাটা ভয়ে রাজি হল না। কীসের এত ভয়, কে জানে।

রিয়া গেল না দেখে শেষপর্যন্ত তারও যেতে ইচ্ছে হল না। একা একাই আজিমপুরের সরকারি কলোনিতে ঘুরে বেড়ালো কিছুক্ষণ। এরপর নিউমার্কেটে একটা চক্কর দিয়ে এসে এবং নীলক্ষেতে মোস্তফা চাচার দোকানে প্রায় ঘণ্টাখানেক পার করে সে যখন বের হল, ততক্ষণে বিকেল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

শেষবিকেলে এই শহরটা অসম্ভব সুন্দর লাগে। মানুষগুলোকেও কেমন যেন সুখী সুখী লাগে। ক্লান্ত, কিন্তু সুখী। সারাদিন কাজ করে বাড়ি ফেরার আনন্দ সবার চোখেমুখে লেগে থাকে। ফারহা একেকজন মানুষের চেহারার দিকে তাকিয়ে কল্পনা করার চেষ্টা করে—কে কী ভাবছে। মধ্যবয়স্ক একটা লোক নিউমার্কেট থেকে বের হচ্ছে, হাতে বিশাল একটা পুতুল! ইশ, লোকটার মেয়েটা আজ নিশ্চয়ই খুব খুশী হবে! নটরডেমের ড্রেস পড়া একটা ছেলে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটছে। একটা রিকশার সাথে ধাক্কা খেতে খেতে শেষমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলো। বেচারা ছেলেটা! নির্ঘাত স্যারের বকা খেয়েছে।

এই মানুষ দেখতে দেখতেই ফারহার চোখ পড়ল একটা রিকশার দিকে। হুড খোলা, কাজেই মানুষ দুজনকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। অমলদা না এটা?! পাশে এই মেয়েটা কে? হঠাৎ ফারহার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো! অমলদা হাত-পা নেড়ে কী কী যেন বলছে, আর মেয়েটা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। রিকশাটা একবার সামনে ধাক্কা খেল, অমলদা পড়ে যেতে ধরতেই মেয়েটা তাকে ধরে ফেলল! আবার রিকশা এগোতে শুরু করেছে…বাতাসে দুজনেরই চুল উড়ছে, দুজনেই হাসছে…এত হাসছে কেন মেয়েটা? আর অমলদাই বা এমন চোখমুখ উজ্জ্বল করে কী বলছে? কই, ফারহার সামনে তো কোনোদিন…

পরদিন একটা ক্লাস টেস্ট ছিল। সারাসন্ধ্যা তার পড়া হল না। মা দুবার করে এসে জিজ্ঞেস করে গেলেন, ‘তোর কি শরীর খারাপ?’ ফারহা অস্পষ্ট স্বরে কী যেন বলল, বোঝা গেল না। মুখে কিছু না বললেও রাতে তার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। সকালে সেই জ্বর ছেড়েও গেল। তবে সারাদিন ক্লাসে মন বসলো না।

সেদিনও ক্লাস শেষ করে ফারহা নীলক্ষেতের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। যদি গতকালের দৃশ্যটা চোখে পড়ে। প্রায় সন্ধ্যে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু দেখতে পেল না। সে বাসায় ফিরলো সন্ধ্যে নামার আগমুহূর্তে। মা ততক্ষণে অস্থির হয়ে চারদিকে ফারহার খোঁজ শুরু করেছেন। ফারহাকে দেখতে পেয়ে অনেক্ষণ বকাঝকাও করলেন। ফারহাকে দেখে হল, সে বুঝতে পারছে না তাকে বকা দেয়া হচ্ছে। শূন্যচোখে কিছুক্ষণ মার দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

এবং তার পরেরদিনও সে বিকেল পর্যন্ত নীলক্ষেতের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।

তার পরেরদিনও।

এবং তার পরেরদিনও।

তিন.

শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। প্রতিদিন না হলেও, সপ্তাহে অন্তত একদিন সে নীলক্ষেতের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে শুরু করল। প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবারেই অমলদার সাথে মেয়েটাকে এই রাস্তা দিয়ে যেতে দেখা যায়। ফারহা চুপ করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। ফুটপাথের দোকানে সাজানো বইগুলো ধরে নাড়াচাড়া করতে থাকে। শীর্ষেন্দুর উপন্যাসগুলোয় হাত বুলোয়। বুদ্ধদেব গুহ নিয়ে খানিক্ষণ দামাদামি করে (বুদ্ধদেবের উপন্যাসের দাম কমালে নাকি পাপ হয় না—বাবা বলেছিলেন)। একসময় চোখের সামনে দিয়ে রিকশাটা চলে যায়। ফারহা ঠোঁট চেপে বাসায় ফিরে আসে। চুপচাপ পড়তে বসে। বাইরে থেকে তেমন কিছু বোঝা যায় না।

বোঝা গেল এক বছর পরে। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার দিন। সস্তা গোল্ডেনের বাজারে ফারহার মত একটা ছাত্রী ফোর পয়েন্ট টু পেয়ে বসে থাকলো। ক্লাসের ফেল্টু মেয়েগুলো পর্যন্ত যেদিন রেজাল্ট পেয়ে সেলফি তুলে ফেসবুক ভরিয়ে ফেলল, সেদিন ফারহা চুপ করে তার ছাদের ঘরটায় বসে থাকলো। একাই। রিয়া অন্তত পঞ্চাশবার ফোন দিলো। সে ধরল না। আশ্চর্যের ব্যাপার, অমলের নাম্বার থেকেও একবার ফোন আসলো। ফারহা সেটাও ধরল না।

চার.

অমল হতাশ চোখে ক্লাসের বোর্ডের দিকে তাকিয়ে ছিল। ইনর্গানিকের স্যারকে যতবারই সে দেখেছে, তার কাছে গল্পের জিনের মত মনে হয়েছে। বিশাল ঢোলা একটা পাঞ্জাবি পড়ে স্যার ক্লাস নিতে আসেন। কীভাবে যেন হাঁটেন—বোঝা যায় না। দূর থেকে মনে হয় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যাচ্ছেন।

স্যার বোর্ডে লেখেনও কোহকাফ নগরের ভাষায়। সেই ভাষার মর্ম ক্লাসের দু-তিনজন ছাড়া আর কেউ উদ্ধার করতে পারে না। কাজেই বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই ঘুমিয়ে যায়। স্যার মাঝেমধ্যে ভাসতে ভাসতে ক্লাসের পেছনে চলে আসেন। যারা ঘুমোচ্ছে তাদের তুলে দিয়ে আবার ভাসতে ভাসতে চলে যান।

বিরক্ত লাগছে অমলের। এর চেয়ে নিজে বই পড়লে কিছু শেখা যেত। রিয়া স্টুপিডটা বারবার করে ফোন দিচ্ছে—তাতে রাগটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। বাসা থেকে বেরুবার আগে অন্তত দশবার বলে এসেছে অমল, আজ তার বিকেল পর্যন্ত ক্লাস। গাধাটার মাথায় যদি একটা কথাও ঢোকে।

এগারোটার ক্লাসটা শেষ করে অমল ফোন ধরল। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে হড়বড় করে রিয়া বলা শুরু করেছে, ‘ভাইয়া তোমাকে আমি কয়েকশোবার করে ফোন দিসি! দিয়েই যাচ্ছি দিয়েই যাচ্ছি! ফোন ধরো না ক্যান? আজকে কিন্তু আমি—’

অমল হুংকার দিল, ‘তোকে বললাম না আমার ক্লাস বিকাল পর্যন্ত?’

বকা শুনে রিয়া হাসতে হাসতে বিষম খেল, ‘চিৎকার কোরো না তো! দুপুরে আমি ফারহাদের বাসায় যাচ্ছি। ও বেচারার মনটন খারাপ। দয়া করে ক্লাসশেষে আমাকে নিয়ে আসবা।’

অমল হতাশ হয়ে ফোনটা পকেটে রেখে দিল। বিড়বিড় করে বলল, ‘গাধা।’

পরদিন অমলের দুটো ইনকোর্স আছে। এখন ফারহার বাসায় গেলেই আংকেলের সাথে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করবে। একবার আড্ডাটা জমে গেলে আর ওঠা যাবে না। তাছাড়া, ফারহার রেজাল্ট দেখে আন্টি নাকি দুদিন ধরে খুব কান্নাকাটি করছেন।

এমন অবস্থায় একটা বাসায় কীভাবে হাজির হওয়া যায়?

পাঁচ.

ফারহাদের বাসার ছাদটা খুব অদ্ভুত। বৃষ্টি হলে ঠিক পানি জমে না। আবার পানি চলেও যায় না। পুরো ছাদে খুব হালকা করে পানি ছড়িয়ে থাকে। ছাদটাকে তখন দেখায় আয়নার মত।

বৃষ্টি নামলে ফারহা প্রায়ই ছাদে গিয়ে বসে থাকে। আয়নার মত ছাদের দিকে তাকালে আকাশটাকে উলটো দেখা যায়। ওপরেও আকাশ, নিচেও আকাশ—দেখতে ভালো লাগে।

আজ ফারহা আর রিয়া দুজনেই ছাদে পাশাপাশি বসে ছিল। রিয়া গুনগুন করে একটা গান গাইছে। অচেনা একটা সুর।

রিয়া ইচ্ছে করেই রেজাল্টের প্রসঙ্গটা তুলছে না। সবাই মিলে ঢঙ করে সান্ত্বনা দিতে শুরু করলে মেয়েটা পাগল হয়ে যাবে না?

অনেক্ষণ চুপ থাকার পর ফারহা কী ভেবে বলল, ‘এই জানিস, অমলদাকে সেদিন নীলক্ষেতে দেখলাম। কার সাথে যেন রিকশায় করে যাচ্ছে!’

রিয়া চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, ‘কার সাথে?’

‘একটা মেয়ে। চিনি না তো ওকে।’

রিয়া বিশাল একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তাই বল। একটা মেয়ে। মাথায় এলোমেলো চুল আর এত্ত বড় চশমা না?’

‘হুম, অমনই ছিল বোধহয়।’

‘ইসরাত আপু ওটা। চারুকলায় পড়ে। আপুর স্কেচ দেখলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবি!’

‘তুই চিনিস ওনাকে?’

‘ভাইয়া পরিচয় করায় দিসিল। আমি আপুকে বলসি, ভাইয়াকে ধাক্কা দিয়ে একদিন রিকশা থেকে ফেলে দিতে। আপু রাজি হয় না’—এটুকু বলতেই রিয়া হেসে কুটিকুটি হল।

ফারহা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস লুকোলো। সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা রিয়ার দৃষ্টি এড়ালো না।

ছয়.

কয়েকদিন পর।

রিয়া চুপ করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। যেকোনো মুহূর্তে ঝড় আসবে। বাইরে তাকালে মনেই হবে না এখন দুপুর তিনটে বাজে। চট করে ঘুম থেকে উঠে কেউ যদি এই আকাশ দেখে, ভাববে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। পাশের বাড়ির আন্টিটা ঝড়ের বেগেই বারান্দার কাপড় ওঠাচ্ছেন। তার সাথে তাল মিলিয়ে ওনার তিন বছরের মেয়েটাও লাফঝাঁপ করে কাপড় পাড়ার চেষ্টা করছে। বেচারার লাফালাফি আর চিৎকারই কেবল সার হচ্ছে। এত মায়া লাগলো রিয়ার! ইচ্ছে হল পাশের বাড়িতে গিয়ে মেয়েটাকে একটু আদর করে দিয়ে আসে। প্রায়ই ভাবে, একদিন হুট করে হাজির হবে। শেষপর্যন্ত আর যাওয়া হয় না।

সিটি কর্পোরেশনের লোকগুলো একটু আধটু কাজ করে বোধহয়। আকাশটা অন্ধকার হতেই রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলো জ্বেলে দিয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে রাস্তাটাকে। দশ-বারো বছরের একটা মেয়ে দৌঁড়ে বাড়ি ফিরছে, আর চিৎকার করছে, ‘আব্বু ঝড় আসলো, ঝড়!’ দৌঁড়ের তালে তার ঝুঁটিটা উড়ছে। মেয়েটার আব্বু বেচারা মোটাসোটা মানুষ, হন্তদন্ত হয়ে মেয়ের সাথে পাল্লা দেয়ার চেষ্টা করছেন। রিয়া হেসে ফেলল। মোটা মানুষদের দৌঁড়াতে ভালোই পরিশ্রম হয়—আংকেলকে দেখে বোঝা যাচ্ছে।

আকাশটা আরেকটু অন্ধকার হতেই রিয়ার রীতিমত বিভ্রম হল। সত্যিই, এখন কি রাত না? জানালায় হাত রেখে বিড়বিড় করে বলল, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার—’

‘পরানসখা বন্ধু হে আমার!’

রিয়া চট করে পেছনে ঘুরে গেল। ভাইয়া দাঁড়িয়ে। অমল মুচকি হেসে বলল, ‘খুব কাব্য হচ্ছে, এ্যাঁ? আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার? দাঁত ফেলে দেবো একদম।’

রিয়া খেপে গেল, ‘তুমি ধমক না দিয়ে একটা কথাও বলতে পারো না?’

‘চোপ। আবার কথা বলে। আরিসসর্বনাশ, বাইরেটা দেখসিশ? দেখ দেখ, একদম মনে হচ্ছে আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার! শোন, বৃষ্টি নামলে তুই একটু বাসাটা পাহারা দিবি। আমি ছাদে গিয়ে ভিজবো। ততক্ষণে চা বানিয়ে রাখিস, বৃষ্টিতে ভেজার পর এক কাপ চা খেতে যা দারুণ লাগবে না, মাইরি!’

রিয়া দুম করে ভাইয়ার পিঠে একটা কিল বসালো, ‘তুমি কী মনে কর নিজেকে, হ্যাঁ? তুমি ভিজবা আর আমি বসে বসে তোমার জন্য চা বানাবো?’

অমল হাসতে হাসতে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করল, ‘আচ্ছা বাবা মারতে হবে না। তুইও ভিজিস, কেমন?’

রিয়া চুপ করে আবার জানালার বাইরে তাকালো। ভাইয়া কীভাবে সবসময় হাসে কে জানে। তার তো সারাক্ষণ এত হাসি আসে না? বরং অকারণেই বারবার মন খারাপ হয়। এখনো হচ্ছে। ফারহার কথাটা ভাইয়াকে বলবে কিনা বুঝতে পারছে না। তাই আরও বেশি খারাপ লাগছে।

ভাইয়া বোধহয় বুঝতে পারছে মন খারাপের ব্যাপারটা। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। জানালার গ্রিল ধরে কী যেন গাইছে গুনগুন করে। ভাইয়ার কী যে বিচ্ছিরি একটা স্বভাব—কেউ বললে কিছুইতে গান করবে না। এমনকি হাত-পা ধরে সাধলেও না। অথচ আপনমনে সারাক্ষণই গুনগুন করতে থাকবে। অনেক্ষণ খেয়াল করার পর রিয়া ধরতে পারলো গানটা। জনি ক্যাশের গলায় শুনেছিল কোনো এক সময়। ভাইয়াই শুনতে বলেছিল।

“ইট্‌স আ লং এ্যান্ড ডাস্টি রোড
ইট্‌স হার্ড এ্যান্ড আ হেভি লোড
এ্যান্ড দা ফোক্‌স এই মেট এইন্ট অলওয়েজ কাইন্ড…”

রিয়ার মাঝেমধ্যে আশ্চর্য লাগে, যে মানুষটা সারাক্ষণ হাসে—সে কেন গুনগুন করে এমন মন খারাপ করা গান গায়?

আরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই রিয়া বলে ফেলল, ‘আচ্ছা ভাইয়া…’

‘বল?’

‘রাগ করবা? একটা কথা বলব।’

‘স্ট্রেইট কথা বলো ইয়াং গার্ল। আই হেইট প্যাঁচাপেঁচি।’

‘ফারহার সাথে সেদিন কথা হচ্ছিল। ও আসলে—’

‘জানি। অনুমান করসিলাম আগেই।’

রিয়া চুপ করে অমলের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। খানিক্ষণ পর বলল, ‘তুমি কী করবা?’

আরও অনেক্ষণ চুপ থেকে অমল বলল, ‘জানি না রে। সত্যিই জানি না।’

সাত.

প্রিয় রিয়া,

খুব ভয় হচ্ছে চিঠিটা লিখতে। তবু সাহস করে লিখতে বসেছি। তোকে কথাগুলো খুলে না বললে আর কাকে বলব?

কিন্তু সমস্যা হল, সব কথা মুখেও বলা যায় না। কাজেই চিঠিতে লিখতে হয়। ভাগ্যিস, চিঠি নামে একটা জিনিস আছে পৃথিবীতে! নাহলে কী মুশকিলে পড়তাম বল তো?

আম্মু গত কিছুদিন ধরে কাঁদছে, কেবলই কাঁদছে। শেষ কবে এমন কিছু দেখেছি—মনে পড়ে না।

জানিস, একবার ভেবেছিলাম, সবাই এসএসসির প্রশ্ন নিচ্ছে, আমিও নেই। সবাই পাপ করলে আমিই বা বাদ থাকি কেন?

পরে মনে সায় দিলো না।

শাওনের আম্মু গতকাল আমাদের বাসায় এসেছিলেন সান্ত্বনা দিতে। সান্ত্বনা দিলেনও বটে। এমনই দিলেন, আম্মুকে আরেক দফা কাঁদিয়ে ছাড়লেন। শাওন গোল্ডেন পেয়েছে—জানিস আশা করি। টেস্ট পরীক্ষায় পাঁচ সাবজেক্টে ফেল করা মেয়ে গোল্ডেন পেল—মজার না ব্যাপারটা? ও আচ্ছা, আন্টি মিষ্টি দিয়ে গেছেন গতকাল। মেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে, মিষ্টি তো দেয়াই উচিত সবাইকে।

ফরিদা ফোন দিয়ে একগাদা কথা শুনিয়েছে। আমি প্রশ্ন না নিয়ে যে একেবারেই বোকার মত একটা কাজ করেছি—সেটা বেশ বুঝিয়ে দিয়েছে। এসএসসির মাঝখানে আমি যতগুলো কথা শুনিয়েছিলাম তার তিনগুণ কথা শুনতে হয়েছে গত কয়দিনে।

হয়তো ভুলটা আমারই। আমি নিতান্তই বোকা। আর বোকারা সবসময়ই একা।

তোর মনে আছে, গত শীতে আমি, তুই, বাবা আর অমলদা ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম? সেই প্রথম এবং শেষবার অমলদার সাথে বসে বকবক করেছি। ঠিক বকবক করেছিও বলা যায় না, গানই শুনেছি বেশি। তোর ভাইটা এত সুন্দর অর্ণব গায়—কে জানতো? আমি তো ভাবতাম, ও কেবল বুড়োদের মত কাট্টাখোট্টা কথা বলতে পারে। তোকে এদ্দিন বলিনি, আজ বলে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। অমলদা যখন গাইছিল, ‘আমার তোমার কি কোথাও হারিয়ে যাওয়ার কথা’—তখন আমার কেমন অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছিল। কই, অর্ণবের গলায় আগেও শুনেছি গানটা, তখন তো এত কষ্ট হয়নি?

না, তুই যা ভাবছিস—সেটা না। অমলদাকে বেশ পছন্দ করি বটে, কিন্তু প্রেমে আমি পড়িনি। কিছু মানুষ আছে, যাদের দূর থেকে দেখতেই বেশি ভালো লাগে। অমলদা তেমন একটা মানুষ। তোর কোনো ভুল ধারণা থাকলে সেটা ভেঙে ফেলিস, প্লিজ।

দোতলায় গিয়েছিলাম একটু আগে। টানা কয়েকদিন আম্মুর সাথে কথা না বলা কী যে কষ্টের—তুই না দেখলে বুঝবি না। গিয়ে দেখি, আম্মু চুপ করে বারান্দায় বসে আছে। আমার মনে হল কাঁদছে। যে মানুষটা সারাক্ষণ হইচই করে ঘরে কাজ করে, এমনকি কিছু না করার থাকলেও নীলুফারের গান ছেড়ে দিয়ে বই পড়তে থাকে, পড়ার তালে তালে আবার মাথাও দোলায়—সেই মানুষটাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখাও খুব কষ্টের।

আমি বোধহয় অন্যদের সময়ে জন্মেছি রে। আমি বেঁচে আছি অন্যদের সময়ে।

বিশ্বাস করবি রিয়া, এত অন্ধকার চারিদিকে? একটু আলো আছে বটে, তুই আছিস, বাবা আছে…কিন্তু ওটা অন্ধকারকে ঢাকতে পারছে না…

খানিক আগে বাবার ড্রয়ার ঘেঁটে এক পাতা ঘুমের ওষুধ নিয়ে এসেছি। দশটাই আছে, একসাথে খেলে কাজ হয়ে যাওয়ার কথা।

সমস্যা হল, বারবার করে বাবার চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছে। কেন এমন হচ্ছে, বুঝলাম না। বাবাকেই তো বেশি ভয় পাই, এমন গম্ভীর হয়ে থাকে সারাক্ষণ। কিন্তু বাবার ছবিটা কল্পনায় আসলেই আর এগোতে ইচ্ছে করছে না।

মায়া লাগছে রে। বড় মায়া লাগছে।

কিন্তু সমস্যা হল, আমি জন্মেছি অন্যদের সময়ে। প্রতিনিয়ত শাওনের আম্মু, ফরিদার আম্মুদের মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার নেই।

প্রিয় রিয়া, আমি খুব খুব স্যরি। আমি জানি তোর কোনো বন্ধু নেই।

কিন্তু আমার কিছু করারও নেই।

ইতি,
ফারহা।


আট.

রাত আড়াইটা।

এই শহরেও রাত নামে। যে নীলক্ষেতের মোড়ে দিনেরবেলা হাজার হাজার মানুষ এঁকেবেঁকে চলে, সেই মোড়টা নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে। ফাঁকা রাস্তায় কেবল স্ট্রিটল্যাম্পগুলো জ্বলতে থাকে। হঠাৎ দু-একটা ভবঘুরে মাথা নিচু করে হেঁটে যায়। পা টেনে টেনে। টহলদার পুলিশটা আড়চোখে চেয়ে দেখে। কিছু বলে না। ভার্সিটির হলের ছেলেরা কখনো দলবেঁধে রাস্তায় বের হয়। একমুহূর্তের জন্য রাতের স্তব্ধতা ভেঙে পড়ে। ছেলেগুলো গলায় জলের গান তুলতে তুলতে চলে যায়। রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে জলের গান আছড়ে পড়ে।

এই শহরে রাত নামে। স্ট্রিটল্যাম্পের ভয়ে নক্ষত্রগুলো মুখ দেখানোর সাহস পায় না। নিতান্ত লুব্ধকের মত দু-একটা সাহসী নক্ষত্র কিছুক্ষণের জন্য উঁকি দেয়। একাই। আকাশের অন্য পাশ থেকে বৃহস্পতি উঁকি দেয়। সেও একা।

রাস্তার আলো কখনই নক্ষত্রের সমান না। তবু নক্ষত্রগুলো ভরসা পায় না। দু-একজন ছাড়া বাকিরা ইচ্ছে করেই অন্ধকারে হারিয়ে যায়। যে হারায়—তার কথা কেউ বলে না। বড়জোর নাজিমউদ্দীন রোড থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়, ‘আহারে!’ এবং এই পর্যন্তই। কার কী আসে যায়? শখানেক স্ট্রিটল্যাম্পের আলোয় সবার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে—আকাশের কয়েকশো বিলিয়ন নক্ষত্র না উঠলে কার কী আসে যায়?

এই শহরে রাত নামে।

একসময় ফারহাদের তিনতলা বাড়িটাও শান্ত হয়ে আসে। ফারহার দরজার সামনে আম্মু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। ঘর অন্ধকার। ভেতরে মেয়েটা কী করছে, কে জানে।

দোতলার বুড়ো আবারও গীটার হাতে নেয়, আবার বছর কুড়ি পরে। কাঁপা হাতে নকিং অন হেভেন্‌স ডোর তুলতে থাকে। শেষরাতের বাতাসে সেই সুর ভেসে বেড়ায়। আর ফারহার দরজায় এসে সেই সুর থমকে যায়। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, ফারহার আম্মুর পাশে।