এলোকথন (শ্রবণা ৪)

আমার মনে হচ্ছে আমরা কিছু একটা হারাচ্ছি। আমি, তুমি, সে—আমরা সবাই।

আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর আগে বিটিভি অসাধারণ একটা অনুষ্ঠান প্রচার করেছিল। নাম ‘জলসা’। উপস্থাপক ছিলেন আনিসুল হক। মেয়র সাহেব যে একসময় উপস্থাপনা করতেন—আমি জানতাম না। আর অতিথিদের মধ্যে ছিলেন…এহ্‌ম, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শ্রদ্ধেয় মুস্তাফা মনোয়ার, খান আতাউর রহমান, কলিম শরাফী, নীলুফার ইয়াসমিন, সোল্‌স, মাইল্‌স ব্যান্ডের সদস্যরা—সে এক দীর্ঘ তালিকা!

অনুষ্ঠানটা দেখে আমার এত ভালো লাগলো, কী বলব। বাইশ বছর আগের মানুষগুলো এত ভালো ছিল? মাত্র বাইশ বছরেই এত পরিবর্তন হয়ে যায়? ওরা একেকজন কথাবার্তা বলছে, মুস্তাফা মনোয়ার স্যার থেকে শুরু করে সে সময়ের ‘পিচ্চি’ পার্থ বড়ুয়া পর্যন্ত—একেকজন কী গভীর থেকে একেকটা বাক্য উচ্চারণ করছে!

বাইশ বছর আগে বোধহয় মানুষগুলোর মধ্যে অনেকখানি গভীরতা ছিল। সে সময়ের গানগুলোই দেখ, আজকের হৃদয় খানের ‘আমি যে তোমার, প্লিজ প্লিজ আমি তোমার, এখন দুইজন মিলে নাচি চলো’—এইসব গানের সাথে সেই সময়ের ‘নিউক্লিয়ার স্বাধীনতা’-র তুলনা হয়? গানের নামটাই তো অসম্ভম রকমের সুন্দর—নিউক্লিয়ার স্বাধীনতা!

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে ফেলার লোভ সামলাতে পারছি না। নিউক্লিয়ার স্বাধীনতার মত কয়েকটা অসাধারণ গান লিখে গিয়েছিল যেই ব্যান্ড, তাদের নাম রকস্ট্রাটা। আশির দশকের ঢাকা শহরে ঘুরে ঘুরে তারা মেটাল ধাঁচের গান করত। তবে সমস্যা হল, তারা শুধু ইংল্যান্ডের ব্যান্ডের গানগুলো কাভার করত, নিজেদের গান ছিল না।

এমন সময় স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হয়, আর সেই উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কনসার্টের আয়োজন করা হয়। আমাদের এই রকস্ট্রাটার সদস্যরা লাফাতে লাফাতে সেখানে গেল—তারাও গান করবে! কিন্তু সমস্যা হল, BAMBA নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল, কনসার্টে কেবল বাংলা গানই গাওয়া যাবে। রকস্ট্রাটা মাথায় হাত দিলো—কারণ তারা কেবল মেটাল গানই করতে চায় এবং ‘বাংলা মেটাল গান’ বলে পৃথিবীতে কোনো কিছু নেই।

কাজেই সে সময় জন্ম হল ঐতিহাসিক একটা মুহূর্তের—রকস্ট্রাটার সদস্যরা বসে বসে অসাধারণ কয়েকটা বাংলা মেটাল গান লিখে ফেলল!

“এই কি আমাদের সমাজের সভ্য মানুষের চির-উন্নত পরিমাপ—
নিউক্লিয়ার স্বাধীনতা?
এই কি যুগ-যুগান্তরের সাধনা চারিদিকে অস্ত্র ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের—
নিউক্লিয়ার স্বাধীনতা?”

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আজকাল আমরা এই গভীরতার জায়গাটুকু থেকে বের হয়ে যাচ্ছি। সবকিছু কেমন যেন সস্তা হয়ে যাচ্ছে। সস্তা কথাবার্তা বেড়ে যাচ্ছে চারপাশে। একটা গভীর কথার চেয়ে একটা সস্তা কথা বললে ‘লাইক’ বেশি পাওয়া যাবে বেশি—কাজেই সবাই সস্তা কথার দিকে ঝুঁকছে।

এই সমাজের ওপর আমি আস্থা হারিয়েছি। আমার দরকার নেই মেইনস্ট্রিমের হালকা সুরের, আমার দরকার নেই মেইনস্ট্রিমের হালকা কথার।

নব্বইয়ের সেই গভীরতা আমি ফিরে পেতে চাই।

আর আমি আমার মত হতে চাই।