এলোকথন (শ্রবণা ২)

অল্প কিছুদিন হল, মাথায় নাইন্টিজের বাংলা ব্যান্ডগুলোর পোকা ঢুকেছে। এর দায় অবশ্য অনেকখানিই শাফিনের। আমি-শাফিন-খালিদব্রো-ইবরাহিম ভাই—আমরা চারজন লালবাগের একটা রেস্তোরাঁয় বসে ছিলাম। বসার কিছুক্ষণের মাঝেই নাটক নিয়ে আলোচনা শুরু হল, কাজেই আমি একেবারে চুপ মেরে গেলাম। নাটক-চলচ্চিত্র নিয়ে আমার যে জ্ঞান—তাতে মুখ খুললে আর মুখ লুকোনোর জায়গা পাবো না। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম, কখন গানের প্রসঙ্গটা ওঠে! তখন ইবরাহিম ভাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে, আর আমি মঞ্চে নামবো!

তা, প্রসঙ্গ উঠলো বটে। শাফিন একটা ভালো কাজ করেছে বোধহয়—নাইন্টিজের বাংলা ব্যান্ডগুলোর প্রায় সবই শুনে ফেলেছে। আমাদের দেশে পেপার রাইম কিংবা রকস্ট্রাটার মত এত অসাধারণ কিছু ব্যান্ড ছিল—আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি আগে। গতকাল রাতে রকস্ট্রাটার প্রথম গানটা শুনতে গিয়ে রীতিমত বেকুব হয়ে গেলাম—১৯৯১ সালের ঢাকা শহরে বসে ছেলেগুলো এমন মেটাল গান গেয়েছে?! মাইরি, কী দুঃসাহস!

[পরবর্তী অংশে অল্পকিছু সেন্টি আছে। ময়মনসিংহ এবং আরামবাগকে চার নম্বর মৃদুবিপদ্‌সংকেত দেখানো হচ্ছে। পরেরদিন ক্লাস বা পরীক্ষা থাকলে এখন ঘুমিয়ে পড়াটাই শ্রেয় হবে।]

কিন্তু এদিকে আমি নিজে দিনদিন বড় ভীতু হয়ে যাচ্ছি। আরিফ ছেলেটা সাহসী বটে। প্রতি রাতে ভয়ে ভয়ে ছেলেটাকে একটা মেসেজ দেই। ছেলেটা শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়। পুরো গল্পটা কীভাবে যেন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে—যখন কেউ ধাপাস করে পানিতে পড়ে যাবে—তখন হাল ধরার জন্য আরেকজন উঠে আসবে। আসবে মানে, আসবেই।

(এই প্রসঙ্গে হালকা একটা কথা বলে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। সেদিনই কেমিস্ট্রির সেমিনারে বসে খালিদ ভাই বলছিল, আমরা একটা শর্টফিল্ম বানাই। নিজেরাই বানাবো। কথাটা বলার সাথে সাথেই হাসতে হাসতে দু-তিনজন বলল, আমাদের মানুষজনের যে অবস্থা—তাতে কিছুক্ষণ ক্যামেরা অন করে রাখলেই একটা ‘ফিল্ম’ হয়ে যাবে, নতুন কিছু করা লাগবে না!)

সে যাক। হাল ধরার ব্যাপারটা বলছিলাম। আদৌ কে কার হাল ধরছে? তটিনী হারালে সেই হাল রিয়া ধরবে, আর রিয়া আকাশে উড়ে গেলে হাল ধরবে আরিফ, আরিফ যখন ঘাসের উপর ধাপাস করে পড়বে তখন আকিব হায় হায় করে উঠবে, ‘গেল গেল আরিফুজ্জামানের জাত গেল’, আর আকিব যখন…

সেও নাহয় কিছু একটা হবে, কিন্তু বৃশ্চিকের হালটা আদৌ কে ধরবে—কে জানে! এও তো এক রহস্য। আরিফ যেখানে বারবার করে বলছে, ‘ভাইয়া সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে’, সেখানে বৃশ্চিক ঠিক একইভাবে বলছে, ‘কোথাও খাপ খাচ্ছে না!’

ও-প্রসঙ্গে আমার মায়া লাগে—নির্দ্বিধায় স্বীকার করছি। অসম্ভব মায়া লাগে। প্রতিটা মমতার আলাদা আলাদা রূপ আছে। (আরিফের প্রতি যেই মায়া সেই মায়া অবশ্যই ফারহানার প্রতি না। আর ফারহানার প্রতি যেই মায়া সে মায়া কখনই বৃশ্চিকের মত না। প্রতিটাই আলাদা।)

বেশি মায়া লাগলে নিজেকে আমার দর্শক মনে হয়।

পুরো নাটকটা খুব দ্রুতই গুটিয়ে আসছে। আমি গতবছর লিখে দিয়েছিলাম, ঘটনাগুলো ছন্দে ছন্দে রঙ বদলাবে, অসম্ভব দ্রুতগতিতে আগাবে গল্পটা। অক্টোবর থেকে জুলাই—মোটে ন’টা মাস গেছে—এর মধ্যে কতগুলো ঝড় চলে গেল?

আমি ঝড় আঁকতে পারি না। এই যে অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো বৃশ্চিক—সেও পারে না। আমরা প্রায় কেউই পারি না, তবু ঝড় বয়ে যায়। আমাদের উঠোনে, আঙিনায়, মস্তিষ্কের মণিকোঠায় কেবলই ঝড় বয়ে যায়।

ঝড়,

হতভম্ব আর্টিস্ট,

আর,

এক সময়…

মানে, একটা সময় ঝড়টা কেটে যাবে…

আর নাটকটুকু শেষ হলে পরের নাটকটা শুরু হবে…

আর আমরা, একটা কথাই বলার বাকি আমাদের…

“যা-কিছু পেয়েছি, যাহা-কিছু গেল চুকে,
      চলিতে চলিতে পিছে যা রহিল পড়ে,
  যে মণি দুলিল যে ব্যথা বিঁধিল বুকে,
      ছায়া হয়ে যাহা মিলায় দিগন্তরে—
জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা—
ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা,
      পূর্ণের পদ-পরশ তাদের ‘পরে।”