লং শট


[ময়মনসিংহের জন্য নিষিদ্ধ। টানা তিনটা উইকলি না দেয়া পর্যন্ত।]

“সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে
কহিল কবির স্ত্রী,
‘রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো
রচিতেছ বসি পুঁথি বড়ো বড়ো
মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো,
তার খোঁজ রাখ কি!”

সোনার তরী কাব্যগ্রন্থে কবিতাটা ছিল। এদ্দিন বাদে হঠাৎ মনে পড়ল। সে এক সাংঘাতিক কবিতা, সাড়ে ছ’শো লাইন—সেই কবিতার ভেতরে আবার আরেকটা পুরো কবিতা!

ঘটনাটা এমন—এক রাতে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, তার মাঝে কবি কেবল লিখেই যাচ্ছে, আর তাই দেখে বেচারাকে তার স্ত্রী খুব করে বকে দিচ্ছে—দিনরাত কবিতা লিখলেই হবে? টাকার অভাবে বাড়িঘর যে ভেঙে পড়ছে! যাও না একবার রাজামশাইয়ের কাছে, উনি বড় দয়ালু, গুণী লোকদের নাকি কদর করেন।

এই শুনে কবি বেচারা ভয়ে এতটুকু হয়ে গেল। স্ত্রীকে তার বড্ড ভয়, ওদিকে আবার রাজাকেও ভয়। কী আর করা, শেষপর্যন্ত স্ত্রীভয়ের কাছে রাজার ভয় হার মানলো, কবি রওনা দিলো রাজপ্রাসাদের দিকে। আর এদিকে কবির স্ত্রী কিন্তু কবিকে খুবই ভালোবাসে, বাইরে যতই বকাবকি করুক। কবি ঘোড়ায় চড়ে রাজপ্রাসাদে যাচ্ছে, আর কবির স্ত্রী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।

সে যাক, কয়েকশো লাইন পরের ঘটনা, কবি রাজার সামনে বসে আছে। কবিতাপাঠ হবে শুনে রাজসভার প্রায় সবাই পালিয়ে গেছে, কেবল কবি আর রাজা মুখোমুখি বসে আছে। কবি দু-একবার ঢোঁক গিলে সাহস করে কবিতা পড়তে শুরু করল—

“প্রকাশো জননী নয়নসমুখে
প্রসন্ন মুখছবি।

বিমল মানসসরস-বাসিনী
শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনী
বীণাগঞ্জিতমঞ্জুভাষিণী
কমলকুঞ্জাসনা,

তোমারে হৃদয়ে করিয়া আসীন
সুখে গৃহকোণে ধনমানহীন
খ্যাপার মতন আছি চিরদিন
উদাসীন আনমনা।

চারি দিকে সবে বাঁটিয়া দুনিয়া
আপন অংশ নিতেছে গুনিয়া,
আমি তব স্নেহবচন শুনিয়া
পেয়েছি স্বরগসুধা।

সেই মোর ভালো, সেই বহু মানি,
তবু মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে প্রাণী—
সুরের খাদ্যে জান তো মা, বাণী,
নরের মিটে না ক্ষুধা।

যা হবার হবে সে কথা ভাবি না,
মা গো, একবার ঝংকারো বীণা,
ধরহ রাগিণী বিশ্বপ্লাবিনী
অমৃত-উৎস-ধারা॥

যে রাগিণী শুনি নিশিদিনমান
বিপুল হর্ষে দ্রব ভগবান
মলিনমর্ত-মাঝে বহমান
নিয়ত আত্মহারা।”

কী সুন্দর! আমি যখন কলেজে পড়ি, প্রায় খ্যাপার মত দিনরাত এই কবিতাটা আবৃত্তি করতাম। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে যেত, ঘরের দরজা বন্ধ করে একা একা কবিতাটা পড়তাম। দুহাত সামনে জড়ো করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলতাম, ‘প্রকাশো জননী নয়নসমুখে প্রসন্ন মুখছবি!’ আর এরপর, দীর্ঘ কবিতাটা!

এক সকালে ঘুম ভেঙে যদি দেখতাম, রবিবাবুর কবিতার এই চরিত্রটা হয়ে গেছি—বেশ হত।

না, কবিতাবন্দনা করতে রাত দুটোয় বিছানা ছেড়ে উঠে ল্যাপটপ খুলে বসিনি। প্রায় ঘুমিয়েই যাচ্ছিলাম। এমন সময় বৃষ্টির শব্দে ঘুমটা চটে গেল। আর সাথে সাথেই আমার মনে হল, ‘সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে, কহিল কবির স্ত্রী!’

ফোন খুলে দেখি, বেচারা মেয়েটা কলব্লক খেয়ে বসে আছে। এতে আমি তেমন চিন্তায় পড়ি না, কারণ এটা খেলার একটা অংশ। যেদিন জন্মের মত ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে—সেটাও খেলারই একটা অংশ হবে।

তবে খেলার অংশ হবে না দশই অক্টোবরের রাত্রি। সম্ভবত, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই রাতটা আমাকে ভাবাবে। আমি ছোটদেরকে সব কথা না বললেও এ্যানি আর তামান্নাকে মোটামুটি সবই খুলে বলতে পারি। আমার চেয়ে বয়সে বড় বলেই হয়তোবা। কিন্তু কী আশ্চর্য, এই একটা ঘটনা আমি ওদেরকে পর্যন্ত বলতে পারি না। সবাই জানে, দশই অক্টোবর যা ঘটেছিল সেটা রিয়া থেকে শুরু করে আজরা পর্যন্ত প্রতিটা মানুষ জানে, অথচ কেউ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারে না। একেই কি ট্র্যাজেডি বলে?

তাতেও সম্ভবত কিছু যায় আসে না, কারণ...

“Life is a tragedy when seen in close-up but a comedy in long-shot!” (–Charlie Chaplin)

আমি তাই মাঝেমধ্যে ভাবি, শালা দশ অক্টোবরের কমেডিটা কোথায় ছিল।