সংবিগ্ন মানুষজন ও আঁকাআঁকি বিষয়ক


[আমি না বলা পর্যন্ত রিয়ার জন্য নিষিদ্ধ।]

এক.

তোহফার সাথে আমার প্রায়ই যে বিষয়টা নিয়ে তর্ক হয় সেটা হল, কে কাকে দেখে ইন্‌স্পায়ার্ড। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, মেয়েটা অসাধারণ পেইন্টিং করে, কোন রঙটা কোথায় কতখানি গাঢ় করে মেরে দিলে কী ঘটে যেতে পারে—সেটা সে আসলেই ভালো বোঝে। আফ্রেমভের সাথে তুলনা করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে নিশ্চয়ই, কিন্তু আমার আশেপাশের মানুষের মধ্যে যারা রঙ সবচেয়ে ভালো বোঝে—তোহফা নিঃসন্দেহে তাদের একজন।

আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, পেনসিল দিয়ে নিরীহ শেড দেয়াতেই আমার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। এই শেডও আবার ইয়াফিজ সিদ্দিকীর হ্যাঁচকা টানের শেড না, অনেক সময় নিয়ে একের পর এক স্তরে দেয়া শেড। যেসব দিনে ভীষণ হাত কাঁপে, সেসব দিন সবচেয়ে গাঢ় অংশগুলোতেও আগে টু বি বসাই। এরপর একটু ভরসা পাই, তখন ফোর বি। হাত আরেকটু শান্ত হলে সিক্স বি, ভূমিকার চুল আঁকার সময় এভাবে নাইন বি পর্যন্ত উঠেছিলাম। (সেই দিনটা আবার বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর ছিল, ইসিই ভবনের বারান্দার গ্রিল খোলা থাকায় ক্লাসের সবাই মিলে জানালা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সানশেডে লাইন দিয়ে বসে ছেলেমেয়েগুলো আড্ডা দিচ্ছিল। অন্তু খুব ভয় পাচ্ছিল—যদি নিচে পড়ে যায়! লাইনের শেষপ্রান্তে আমি আর নিলয়। আমি চুপচাপ ছবিতে শেড দিচ্ছি। নিলয় মাঝেমধ্যে দু-একটা ভুল ধরিয়ে দিচ্ছে, ওগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি। একসময় টুপুরটাপুর করে বৃষ্টি শুরু হল। তবু ছেলেমেয়েগুলো বসেই থাকলো। বৃষ্টির ছাঁট এসে স্কেচের ওপর পড়ছে, আমি বারবার রুমাল দিয়ে মুছে ফেলছি। অন্ধকারও যথেষ্ট হয়ে এসেছে, স্কেচটাকে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি গাঢ় লাগছে। ইশ, মানুষের জীবনে এই দিনগুলো কি একবারই আসে?)

আমি চাই, এই দিনটা আমার জীবনে দ্বিতীয়বার আসুক। আপাতত আমার খুব ইচ্ছা, টার্ম ফাইনালটা শেষ করেই নতুন একটা ছবিতে হাত দিবো। এবং সম্ভবত এটা হবে আমার ভার্সিটিজীবনের শেষ পোর্ট্রেট।

ভেতর থেকে না আসলে ছবি কি আর জোর করে আঁকা যায়? এই যে পোর্ট্রেটটার কথা বললাম, গত এক বছর ধরে আমি ছবিটা আঁকতে চাচ্ছি। এই দীর্ঘ এক বছরে এমনও রাত গেছে, যেসব রাতে নেশাগ্রস্ত মানুষের মত আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে—আমার মনে হয়েছে, যেকোন মূল্যে এই ছবিটা আমাকে আঁকতে হবে। কোনো এক বিষম মুহূর্তে ছবিটা চোখে লেগে গিয়েছিল বোধহয়!

‘চারণ দেখেছে এই ছবিখানি তাই
হৃদয়ে জমেছে শূন্যতা উড়ু মেঘ
চারণ ভোলে না এই ছবিখানি তাই
বড় মায়া লাগে, বড় তার উদ্বেগ।’

আসলেই, বড় মায়া লাগে রে। যাদের স্কেচে টুকটাক আগ্রহ আছে তারা জানে, একেকটা ডিটেইল্‌ড স্কেচের পেছনে কী অসীম মমতা থাকে মানুষের!

দুই.

আর মমতা থাকে সংবিগ্ন মানুষগুলোর প্রতি।

আজ বিকেল থেকে এ্যানির সাথে দীর্ঘ আড্ডা দিয়েছি। বেচারা মেয়েটা দিনে দিনে জন কিট্‌স হয়ে যাচ্ছে। শুধু কবিতা লেখাটা বাকি। কিছুদিন আগে হিসেব করে বের করেছি, আমার সমবয়সী বন্ধু ঘুরেফিরে এই দুটোই আছে। একজন এ্যানি, আর অন্যজনের নামও অননুমেয় কিছু না। হিসেবটা করার পর এই মানুষ দুটোকে বড় দামি মনে হচ্ছে।

যাকগে। পদ্মর নানুর কথা বলি। নানুকে সেদিন দুঃখ করে বলছিলাম, বুয়েটের প্রায় সব আন্দোলনই হয় পরীক্ষা পেছানো, ক্লাস বন্ধ করা—এসব নিয়ে। অথচ সারাদেশে যেদিন ছাত্র ধর্মঘট ছিল, সেদিন পাঁচ পার্সেন্ট ছেলেও ক্লাস থেকে বের হয়নি।

এই কথা শুনে নানু মুচকি হাসলো। বলল, ওনাদের সময়ও নাকি এমনটা হত। পদ্মর নানু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো ১৯৭০-এর দিকে। সে সময়ও ঢাবিতে যখন আন্দোলন হত, তখন নাকি বুয়েটের ছেলেমেয়েরা নিয়মিত ক্লাসে যেত। আর নানুদের কিছু শিক্ষক নাকি বলতো, ‘দেখো বুয়েটের ছেলেমেয়েরা কত ভালো, ওরা ক্লাস করছে!’

কিছু সিরাজ সিকদার অবশ্যই ছিল বুয়েটে। কিন্তু সংখ্যাটা এত অপ্রতুল, কষ্ট হয় মাঝেমধ্যে।

আচ্ছা এক মিনিট, আজকের যুগে এই সংখ্যা কি সবখানেই অপ্রতুল না? মিরপুর রোডের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে এ্যানি এই কথাটাই জিজ্ঞেস করছিল। 

আমি বলেছি, সময় লাগবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খালিদ বিন ইসলামের মত অসাধারণ কিছু মানুষ ঘোরাফেরা করে—এরা কি বড় হয়ে মুনীর চৌধুরী, জি সি দেবের শূন্যস্থানগুলো পূরণ করবে না? আমার বিশ্বাস, করবে।

আর শহীদুল্লাহ কায়সার বেঁচে থাকলে আমার এই স্পর্ধাটুকু নিশ্চয়ই ক্ষমা করতেন যে, আমি ওনার শূন্যস্থানটুকু পূর্ণ করতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব।

তিন.

আচ্ছা, আমাকে একটা কথা মানুষ প্রায়ই বলে, আমি যেন বদলে না যাই। কেন বলে?

জানি না। শুধু জানি, শেষপর্যন্ত আমি ঠিকই বদলে যাই। একটা সময় ছিল, আমি ভাবতাম আমার ব্লগ কেউ পড়ে না। সেই সময় আমি মনের আনন্দে লিখে যেতাম, কেবলই লিখতাম! যখন টের পেলাম, বেশ কয়েকজন পড়ে—তখন থেকে লেখাগুলো এলোমেলো হতে শুরু করল। আমি বদলে গেলাম। এখন প্রতিটা বাক্যের আগে আমার মাথায় আসে, এই বাক্যটা পড়লে আরিফের হার্ট এ্যাটাক হবে কিনা, কিংবা অমুক কথাটা শুনলে ফারহানা পড়াশোনা ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে কিনা। কাজেই যা লিখি, তার আশি শতাংশ নির্মমভাবে কাটি। এরপরও সব লেখা নিরাপদ মনে হয় না, সেসব লেখা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হয়।

নাকি এটাকে বদলে যাওয়া বলে না?

ঘুম ঘুম চোখে আমার মনে হচ্ছে, রাত দুটোর সস্তা ফিলোসফি করছি আমি। সকালে উঠে সব ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে কাটতে হতে পারে। তবে তার আগে একটা কথা বলে শেষ করি।

মাই কেমিক্যাল রোমান্সের অসাধারণ একটা গান আছে, ক্যান্সার নামে। যতবারই শুনি, কেন যেন একটা আফসোস এসে ভর করে। এ্যাঞ্জেলার মতে, আমি সারাক্ষণ নিজের যা ভালো লাগে তাই করে বেড়াই—কাজেই আফসোসটা ঠিক আমার দিক থেকে না। আফসোসটা এই দিক থেকে যে, দা হার্ডেস্ট পার্ট অফ দিস ইজ লিভিন’ ইউ।

“If you say
Goodbye today
I’d ask you to be true
‘Cause the hardest part of this is leaving you.”