বাক্‌সো

প্রায় এক যুগ পর অথৈ পিচ্চিটা ফোন দিল। এটা আশ্চর্য না, তবে আশ্চর্য এই যে, কিছুদিন ধরে ঘুরেফিরে বারবার পিচ্চিটার কথা মনে পড়ছিল। মোটামুটি ছোটবেলা থেকেই কুইন শুনি, কিন্তু আজকাল কুইন শুনতে গেলে প্রায়ই অথৈয়ের কথা মনে পড়ে যায়। আমার ধারণা, এর পেছনে ফ্রেডি মার্কারির একটা বিশাল ভূমিকা আছে।

গল্পটা বলে ফেলতে ইচ্ছে করছে। একটা ব্লকে আটকে ছিলাম, লিখতে গেলেই হাত আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। পিচ্চিটা ফোন দিয়ে এক ধাক্কায় ব্লক ভেঙে দিল!

ফ্রেডি মারা যাবার আগের দিনগুলোতে বারবার করে বলছিল, “Write me more. Write me stuff. I want to just sing this and do it and when I am gone you can finish it off.” মৃত্যুর মাসকয়েক আগে ছেলেটা অসাধারণ কিছু গানও গেয়ে গেছে। সেই গানগুলো শুনলে মিশ্র একটা অনুভূতি হয়। একজন মানুষ যখন জানে যে সে মারা যাবে, আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, রক ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কিংবদন্তিদের একজন যখন জেনে ফেলে যে, সে কিছুদিনের মাঝেই মারা যাচ্ছে—তখন সে যা যা করতে পারে—সেটা আর দশটা মানুষের পক্ষে করা প্রায় অসম্ভব।

গতকাল কুইনের শেষদিকের একটা গান হঠাৎ চোখে পড়লো, এদ্দিন পড়েনি। না পড়ে খুবই ভালো হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে অল্প অল্প করে কুইনের জন্য অনেকখানি ভালোবাসা জন্মেছিল। ভালোবাসা জন্মেছিল ফ্রেডির প্রতিও। এরপর যখন দেখলাম, মারা যাবার ক’মাস আগে ছেলেটা These Are The Days Of Our Life-এর মত একটা গান গেয়েছে, তখন…খুব অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়েছিল। দীর্ঘদিন কুইন না শুনলে এটা বোঝা কঠিন।

গানটা তুমি যখন শুনবে, তুমি মৃত্যুর ঘ্রাণ পাবে, গানের সাথে সাথে সেটার পদধ্বনি তোমার কানে বাজবে। কিন্তু অদ্ভুত এই যে, এই মৃত্যুর মধ্যে ভয়াবহতা নেই, কোথায় যেন একটা প্রশান্তি আছে। গানের কথাগুলো, ব্রায়ান মের একেকটা শান্ত সলো, ফ্রেডির শান্ত হাসি—সবকিছুর মধ্যে একটা accept করে নেয়ার ব্যাপার আছে।

ব্রায়ান মে ছেলেটাকেই বা ফ্রেডির নিচে রাখি কী করে। গিটারকে দিয়ে এত কথা বলানো যায়—কে জানতো? ব্রায়ান মে যখন সলো বাজাবে—তুমি কেবল কান দিয়ে শুনেই বুঝবে—গিটার সলোটা প্রেমের কথা বলছে, নাকি দ্রোহের কথা বলছে। নাকি মৃত্যুর কথা। কই, আমি এই খ্যাত যে এতদিন ধরে টুংটাং করে যাচ্ছি, কোনোদিন তো গিটারকে দিয়ে এভাবে কথা বলাতে পারলাম না?

নাহ, ব্রায়ান মে ছেলেটা গিটার বাজাতে পারতো, স্বীকার করতেই হবে।

আচ্ছা, সেও যাক। অথৈয়ের কথা কেন বারবার মনে পড়ছিল, সেটা বলি। বেশ ক’মাস আগে অথৈ একদিন ফোন দিয়ে উত্তেজিত গলায় বলছিল, তার নাকি কুইনের গান খুবই ভালো লেগেছে। এরপর ফ্রেডি মার্কারির ওপর একটা ডকুমেন্টারি দেখে শেষে কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা। আরও কী কী যেন বলেছিল, এখন মনে নেই সব।

অথৈ পিচ্চিটার এ জিনিসটা আমার অসাধারণ লাগে—মেয়েটা গান চেনে। মহীনের ঘোড়াগুলির ‘হায়, ভালোবাসি’ শুনে কেন বারবার মুগ্ধ হতে হয়—এটা সে জানে। ফ্রেডি মার্কারির গানের সাথে যে মাথা ঝাঁকাতে হয়—এটা সে মানে। আবার দাড়িঅলা বুড়োটার ‘পলকের পরে থাকে বুক ভরে চিরজনমের বেদনা’ কথাটা অর্থ কী—এটাও সে বোঝে।

অথৈ বলছিল, যারা দাড়িঅলা বুড়োটার গান শোনে, তারা কেন যেন রক গান পছন্দ করে না। কথাটা সত্যি বটে। আবার যারা রক গান শোনে—দাড়িঅলা বুড়ো তাদের দুচোখের বিষ!

কই, আমার তো সব ভালো লাগে? অথৈয়েরও লাগে।

সুতরাং আমাদের বিশ্বাস, আমরা দুজনেই পাগল।

(এইবেলা স্বীকার করে নেয়া উচিত, মমতাজের গান ভালো লাগে না! জাস্টিন বিবারও ভালো লাগেনি। সবাই শোনে দেখে মাঝখানে শোনার চেষ্টা করেছিলাম। শেষপর্যন্ত একবার ‘ইয়াক’ উচ্চারণ করে কেটে পড়তে হয়েছে।)

অথৈ পিচ্চিটার সাথে একটা শান্তিচুক্তি করেছি। ওকে একটা বাক্‌সে করে গান পাঠিয়ে দিবো। বাক্‌সোভর্তি এত্তগুলো গান থাকবে, খুললেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসবে। বাক্‌সে করে কীভাবে গান পাঠাবো সেটা আমার ব্যাপার, তবে গান পাঠালে তাকে এক এক করে সব শুনতে হবে।

এই কল্পনাটা আমাকে শান্তি দেয়।

এই কল্পনাটা আমাকে অসম্ভব শান্তি দেয় যে, আমার পিচ্চিটা এক সন্ধ্যায় বসে গানগুলো শুনতে শুনতে মুগ্ধ হবে।

এই যেমন, ধরো, এক সন্ধ্যায় খুব বৃষ্টি হচ্ছে, চারপাশে একইসাথে একটা মন-ভালো-করা এবং মন-খারাপ-করা ভাব, এমন সময় রবার্ট প্ল্যান্টের গলায় কেউ শুনছে,

“Little drops of rain
Whisper of the pain
Tears of loves lost in the days gone by…”

উফফ, বৃষ্টির সন্ধ্যায় রবার্ট প্ল্যান্টের গলা, জিমি পেইজের সলো, সাথে জন বোনহামের অসাধারণ ড্রাম বিটগুলো—এগুলো কি একটা মানুষকে স্বর্গ এনে দিবে না?

হুম, বাক্‌সোভর্তি গান যে করেই হোক আমাকে জোগাড় করতে হবে।