দেবতার গ্রাস

এক.

শেষবিকেল। এই সময়ে কার্জনের পুকুরপাড়ে অনেক ছেলেমেয়ে থাকার কথা। আজ বোধহয় রোদটা একটু চড়া দেখেই খুব বেশি মানুষ দেখা যাচ্ছে না। কেবল তিনটে ছেলেমেয়ে বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে বসে আছে।

বামদিকের ছেলেটার নাম শাফিন। বয়স বাইশ বছর হয়ে গেলেও তাকে দেখে সতেরোর বেশি মনে হয় না। বাইশ বছরের যেই ছেলেকে সতেরো বলে মনে হয়—তাকে সবাই খুব আদর করে। কাজেই শাফিন থার্ড ইয়ারে উঠেও ভার্সিটিতে আদুরে বেড়ালের মতই ঘুরে বেড়ায়। বড় ভাইদের সাথে দেখা হলে ম্যাঁও ম্যাঁও জাতীয় শব্দ করে আদর নেয়ার চেষ্টা করে। আদর সে পায়ও বটে। শোনা যায়, মাস্টার্সের কোন এক বড়ভাইয়ের সাথে তার খুবই খাতির। দুজন মিলে নাকি রাঙামাটির কোন এক জঙ্গলে…আচ্ছা, সে কথা থাক। সব রহস্য সবখানে ফাঁস করতে নেই।

শাফিনের ডানদিকে নোবেল আর শাওন বসে আছে। নোবেল কিছুক্ষণ পরপর ফিক করে হেসে ফেলছে। হাসির শব্দ শুনে শাওন বারবার বিষদৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। মেয়েরা সাধারণত হাসিখুশি হয়। মোটা মেয়েরা আরও বেশি হাসিখুশি হয়। আর প্রস্তরযুগের হাতির মত মোটা মেয়েরা খুবইইই বেশি হাসিখুশি হয়। শাওন প্রস্তরযুগের হাতির মত মোটা। কাজেই সে খুবই হাসিখুশি থাকে। তবে আজ বোধহয় তার মন একটু খারাপ। চোখের দৃষ্টিতে বারবার বিষ ঝরে পড়ছে। সেই বিষ অবশ্য নোবেলকে স্পর্শ করছে না। সে একটু পরপরই ফিক করে হেসে ফেলছে।

শাওন বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ভাইয়া আপনি যে কী না! আমরা একটা জরুরি কাজ করব, এখন হাসাহাসি না করলেই না?’

নোবেল হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘না, মানে, আমরা লাফ দেয়ার পর খালিদ ভাই কীভাবে বিডিজেএসও সামলাবে—সেটা ভেবেই মজা লাগছে। শাফিন, মজা পাচ্ছো না খুব?’

শাফিন মাথার চুল খামচে পুকুরের দিকে তাকিয়ে ছিল। হতাশ গলায় বলল, ‘খুবই মজা পাইতেসি।’

শাওন করুণ গলায় বলল, ‘শাফিন ভাই, আমরা পুকুরে লাফ দেয়ার পর বিডিজেএসও-র কী হবে? নব্বই সেট প্রশ্নের অর্ধেকও বানানো হয়নি, মাইরি।’

এবার নোবেল হো হো করে হেসে উঠলো! শাফিনের ঠোঁটেও হালকা হাসি দেখা গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে গাঢ় গলায় বলল, ‘নব্বই সেট! নব্বইটা আঞ্চলিক অলিম্পিয়াড খালিদ একা ম্যানেজ করবো এইবার। অনেক হইসে বাপ, আমি আর পারুম না প্রশ্ন বানাইতে।’

নোবেল বলল, ‘আমিও পারবো না।’

শাওন প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, ‘আঁমিঁওঁ নাঁ ভাঁইঁয়াঁ!’

নোবেল চোখ বড় বড় করে শাওনের দিকে তাকালো, ‘শুভমুহূর্তে কাঁদছিস কেন? আমরা মুক্তি পাচ্ছি, কাঁদবে তো খালিদ ভাই। আয়, লাফ দেই।’

শাফিন বলল, ‘যত প্রশ্ন বানানো হইসে সব ব্যাগে নিসোস তো? খালিদ যেন একটাও না পায়, সব আমাগো লগে পানিতে যাইবো।’

‘হুম, নিসি সব,’ নোবেল উৎফুল্ল গলায় বলল, ‘শাওন নিসিশ না সব?’

‘এ্যাঁএ্যাঁএ্যাঁ! নিঁসিঁ ভাঁইঁয়াঁ!’

এরপর।

এরপর, তারা তিনজন এক লাইনে হাত ধরে দাঁড়ালো।

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আশ্চর্য হয়ে দেখলো, জুলাইয়ের এক রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে তিনটে ছেলেমেয়ে ঝুপ করে পুকুরে উল্টে পড়ে গেলো।

দুই.

সন্ধ্যে সাতটা। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের মেধাবী শিক্ষার্থী খালিদ বিন ইসলাম বসে আছেন দ্বিতীয় আলো অফিসে। সাধারণত শিক্ষার্থীরা মেধাবী হন মরে যাবার পর। খালিদ বিন ইসলাম জীবন্ত মেধাবী। তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তী প্রচলিত। অর্গানিক ল্যাবে তাঁকে নাকি কোনো টেস্ট করতে হয় না। যেকোনো যৌগ চেটে তিনি বলে দিতে পারেন সেখানে কোন মৌল কী পরিমাণে আছে। সমস্যা হল, একবার ভাইভার সময় স্যার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বলো তো তোমার শরীরে কোন মৌল কী পরিমাণে আছে?’

এরপরের ঘটনাটা পরিষ্কার জানা যায় না। কেউ বলে, এই প্রশ্ন শোনার পর খালিদ বিন ইসলাম অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিজেকে চেটে দেখতে শুরু করেন। কেউ বলে, তিনি চেটেই গিয়েছিলেন, ভাইভার সময় কেবল মুখস্থ উত্তর দিয়েছেন।

আজ অবশ্য দ্বিতীয় আলো অফিসে তিনি বিডিজেএসও-র বাজেট ডিজাইন করছিলেন।

কাজ করতে করতেই তাঁর ফোন আসলো। তিনি তাঁর মেধাবী হাত দিয়ে ফোনটি রিসিভ করে মেধাবী মুখ দিয়ে মেধাবী ভঙ্গিতে বললেন, ‘হ্যালো।’

ওপাশ থেকে হাহাকার শোনা গেল, ‘খালিদ, সর্বনাশ হইসে!’

তিনি আগ্রহের সাথে বললেন, ‘কী সর্বনাশ?’

‘তুই কি বিডিজেএসও ফিজিক্স নোবেলকে দেখতে বলসিলি?’

‘হাঁ হাঁ, বলেছিলাম বটে।’

‘হায় হায়! কেমিস্ট্রির দায়িত্ব শাফিনকে দিসিলি?’

‘হাঁ, দিয়েছিলাম বটে।’

‘…আর বায়োলজি প্রশ্ন কি শাওনের করার কথা?’

‘হাঁ, তাই করার কথা বটে! কেন?’

যে ফোন দিয়েছিল সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘তিনজনই আজকে বিডিজেএসও-র সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে শহীদুল্লাহর পুকুরে ডুবে গেসে‼’

খালিদ বিন ইসলামের শান্ত ভঙ্গিটা এবার কেটে গেল। তিনি ধড়ফড় করে উঠে বললেন, ‘এ কী বলছিস তুই। এবারের বিডিজেএসও কতগুলো অঞ্চলে হবে, জানিস? নব্বইটা অঞ্চলে, নব্বই। আমার প্রশ্নগুলো সব জলে গেল? হায় হায়, আমার নব্বই সেট প্রশ্ন জলে গেল!’ বলতে বলতেই তিনি ব্যাকুলভাবে কাঁদতে লাগলেন।

‘এত কষ্ট পাস না খালিদ। আবির তো আছে, ওকে কেমিস্ট্রির দায়িত্বটা দে।’

এবার খালিদ বিন ইসলাম হঠাৎ কান্না থামিয়ে হো হো করে হাসতে শুরু করলেন। ‘কাকে দিবো? আবিরকে? হো হো হো, হি হি হি, আবির? আহ হা হা হা হা, দারুণ ছেড়েছিস, হাসিটা থামাতেই পারছি না! হো হো, আবির!’

তিন.

রাত সাড়ে ন'টা। খালিদ বিন ইসলাম দিশেহারা ভঙ্গিতে শহীদুল্লাহর পুকুরপাড়ে বসে আছেন। ডানহাতে একটি কোকের বোতল, বাম হাতের আঙুলের ফাঁকে ধরা পেনসিল। তিনি এক চুমুক করে কোক খাচ্ছেন, আর পেনসিলটি মুখে নিয়ে কামড়াচ্ছেন।

তিনি পুকুরের পানিতে মৃদু থাবড়া দিলেন। প্রায় শোনা যায় না এমন গলায় ডাকলেন, ‘শাফিন? এই শাফিন।’

ঘাটে ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ।

তিনি ঘাটের সিঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে হাপুস-হুপুস করে কাঁদতে লাগলেন। ‘শাফিন, তোরে ভাই ভাবসিলাম। ভাই ডুবলি তো ডুবলি, বাকি দুইটারেও ডোবালি। ব্যাটা বিডিজেএসও-র প্রশ্নগুলো ঘাটে রেখে যেতে পারলি না? এবার কটা জায়গায় বিডিজেএসও হবে, জানিস? নব্বই সেট প্রশ্ন এখন কে বানাবে?’

এমন সময় তাঁর মেধাবী ফোনটি বেজে উঠলো। ইবরাহিম ভাইয়ের ফোন। তিনি ফোন ধরে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ‘ইবরাহিম ভাই, সর্বনাশ হয়েছে গো।’

ওপাশ থেকে ইবরাহিম ভাই ভয়ার্ত গলায় বললেন, ‘আরে রাখ তোর সর্বনাশ। এবার কয় অঞ্চলে বিডিজেএসও হবে, জানিস? নব্বইটা অঞ্চলে, নব্বই। আমাকে আজ রাতেই নব্বই সেট প্রশ্ন মেইল করবি। নব্বইটা প্রেস রিলিজও লিখবি,’ বলেই তিনি ফোন কেটে দিলেন।

খালিদ বিন ইসলাম অনেক্ষণ চোখ বড় বড় করে সামনে তাকিয়ে থাকলেন। একসময় উদ্‌ভ্রান্তের মত হেসে উঠলেন, ‘নব্বইটা প্রেস রিলিজ লিখবো! হি হি হি!’

এরপর।

এরপর তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। বিডিজেএসও-র বাকি কাগজপত্র সব গুছিয়ে ব্যাগে ভরে নিলেন।

আর বুড়ি চাঁদটা আশ্চর্য হয়ে দেখলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী খালিদ বিন ইসলাম বিডিজেএসও-র সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে নিয়ে ঝুপুস করে শহীদুল্লাহর পুকুরে পড়ে গেলেন।

চার.

পরদিন। দুপুর বারোটা।

জহিরের ক্যান্টিনের এক কোণায় ইবরাহিম বসে আছে। মোটামুটি বিধ্বস্ত চেহারা। দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমায়নি।

সুষ্মী পাশের বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছে। চায়ের কাপে একটা করে চুমুক দিয়ে বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।

চা শেষ করে সুষ্মী ঠকাস করে কাপটা রাখলো।

একবার ইবরাহিমের দিকে তাকালো।

এরপর দুজনেই তারস্বরে কেঁদে উঠলো!

‘নোবেলটা গেলো রে!’ সুষ্মী বলল।

‘খালিদটা ডুবলো রে!’ ইবরাহিম বলল।

সুষ্মী কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল, ‘আমার সুনীলের বই এখন কীভাবে ফেরত পাবো রে, ভ্যাঁএ্যাঁএ্যাঁ!’

ইবরাহিম গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘হতভাগা শাফিন প্রশ্ন নিয়ে ডুবলি, আর কাগজপত্র যা বাকি ছিল তা নিয়ে খালিদও ডুবলি?’

সুষ্মী চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, ‘কেঁদে আর কী করবি? যা বাসায় গিয়ে নব্বই সেট প্রশ্ন বানাতে বস।’

এই শুনে ইবরাহিম খুবই খেপে গেল। হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলল, ‘করবো না, করবো না!’ এরপর অবিকল ফ্রেডি মার্কারির মত I want to break free গাইতে গাইতে জহিরের ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে আসলো।

সুষ্মী পেছন পেছন বেরিয়ে এসে বলল, ‘সে কী? তার মানে কি তুইও এখন…’

‘হ্যাঁ! আমিও!’

‘কিন্তু কোনদিকের ঘাট দিয়ে ডুববি? নোবেলরা ডুবেছিল বাম দিকের ঘাট থেকে, আর খালিদ ডান দিকের ঘাট থেকে।’

‘তুই আমাকে ভাবিস কী? আমি বামদিকের ঘাট থেকেই লাফ দিবো,’ বলতে বলতেই ইবরাহিম দৌঁড়ানো শুরু করলো।

আর সুষ্মী দেখলো, ইবরাহিম দৌঁড়াচ্ছে, দৌঁড়াচ্ছে, বামদিকের ঘাটে পৌঁছানোর পর, না তখনও থামলো না, ঘাট পার হয়েও দৌঁড়াতে থাকলো, দুই ঘাটের মাঝামাঝি একটা জায়গায় এসে দাঁড়ালো।

এরপর।

এরপর সুষ্মী আশ্চর্য হয়ে দেখলো, ইবরাহিম সামান্য, খুবই সামান্য একটু ডানে ঘেঁষে ঝুপুস করে পুকুরে ঝাঁপ দিলো!

পরিশিষ্ট.

‘…শুধু ক্ষীণ মুঠি,
বারেক ব্যাকুল বলে ঊর্ধ্ব-পানে উঠি
আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে।
‘ফিরায়ে আনিব তোরে’— কহি উর্ধ্বশ্বাসে
ব্রাহ্মণ মুহূর্ত-মাঝে ঝাঁপ দিল জলে।
আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে।।’

(—দেবতার গ্রাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)