এলোকথন (শ্রবণা ৫)

নাহ, কোনোভাবেই পড়ায় মন বসাতে পারছি না।

আমার ধারণা, গত কিছুদিনে খানিকটা ওভারলোড হয়ে গেছে। কতখানিই বা ব্রেইন আমার মাথায়, বড়জোর সিকি চামচ হবে—ও বেচারার পক্ষেও তো এতখানি চাপ নেয়া কঠিন।

কাল ডাটাকম পরীক্ষা আমার। কোর্সটার আসল নাম ডাটা কমিউনিকেশন ওয়ান। সবাই আদর করে ডাটাকম বলে ডাকে।

যেই স্যার আমাদের ক্লাস নিতেন, ওনার সাথে আমার একটা মজার কাহিনী আছে। কোনো এক টার্মে ওনাকে অফলাইন দেখাতে গিয়েছি। স্যার কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি ছবি আঁকো?’

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। বললাম, ‘জ্বী স্যার।’

স্যার আমার কোড দেখতে দেখতে বিড়বিড় করে বললেন, ‘চুল দেখে বুঝছি। যারা ছবি আঁকে তারা সাধারণত কোডিং-এ ভালো করে না!’

মনে আছে, সেদিনের স্যারের সামনে অনেক কিছুই কনফেস করেছিলাম। আমি চলে আসার আগে স্যার বলেছিলেন, ছবি আঁকতে ভালো লাগলে অবশ্যই আঁকবা। কিন্তু পড়াশোনায় মন রেখো, একেবারে সন্ন্যাসী হয়ে যেয়ো না।

জানি না কেন, একটু আশ্চর্যই বলতে হবে ব্যাপারটাকে, সেদিনের পর থেকে স্যাররা আমাকে খুব একটা বকাটকা দেননি। অন্তত সেই কোর্সের স্যাররা। তানভীর স্যার, খালেদ স্যার তো ইচ্ছেমত সবাইকে বাঁশ দিতেন। শুধু আমাকে কিছু বলতেন না। উল্টো আরও অনেক্ষণ সময় নিয়ে আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দিতেন। সিদ্ধার্থ স্যার তো একদিন প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে বসে আমাকে একটা এলগোরিদম বোঝালেন। আমার পরে যাদের রোল তারা অপেক্ষা করে আছে, আর সিদ্ধার্থ স্যার আমাকে বুঝিয়েই যাচ্ছেন!

আমার ব্যাপারে ভার্সিটির স্যারদের মোটামুটি দুভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। অর্ধেক স্যার বেশ পছন্দ করেন। কেন করেন—সেটাও একটা রহস্য। আমার উদ্ভট এ্যাসেম্বলি প্রজেক্ট দেখে সবাই আনন্দ পেয়েছিল বটে, কিন্তু মধুসূদন স্যার যে হাততালি দিতে শুরু করবেন—সেটা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। অথবা সিদ্ধার্থ স্যার যে এখনও বাচ্চাদের আমার কাছে পাঠান জাভা প্রজেক্টের জন্য—এটাও তো মোটামুটি অবিশ্বাস্যই। (জাভা প্রজেক্টের কথা আসায় মনে পড়ে গেল—সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে সিদ্ধার্থ স্যারের আন্ডারে একটা গেম বানিয়েছিলাম। গেমের কাজ মোটামুটি শেষ হওয়ার পর স্যার আর আমি একসাথে বসে সেটা খেলেছি! স্যার দুম দুম করে আমাকে গুলি করছেন, আর ছেলেমানুষের মত খুশি হয়ে বলছেন, বাহ বাহ! সেই দিনটার কথা মনে পড়লে এখনও মজা লাগে!)

যা বলছিলাম। অর্ধেক স্যার আমাকে পছন্দ করেন, আর বাকি অর্ধেক দু চোখে দেখতে পারেন না। পারলে কাঁচা খেয়ে ফেলেন আরকি! তাঁদের বেশিরভাগই অবশ্য ট্রিপল ই ডিপার্টমেন্টের। তাঁদের পছন্দ না করার কারণটাও মোটামুটি একই—আমার পাগলামি।

অদ্ভুত না? আমি পাগল দেখেই অর্ধেক স্যার পছন্দ করে, আর বাকি অর্ধেক করে না।

ও আচ্ছা, সেকেন্ড ইয়ারের একটা কথা মনে পড়ে গেল। ইলেকট্রিকালের এক স্যার আমাকে খুব বকা দিচ্ছেন ল্যাবে। মানে, ঘটনা হয়েছিল যে, সেই স্যারের প্রথম ল্যাবে আমি হেসে ফেলেছিলাম। এরপর থেকে স্যার প্রত্যেকদিন ল্যাব শুরুর আগে আমাকে ডেকে নিতেন। বিভিন্ন যন্ত্র দেখিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করতেন। একসময় আমি আটকে যেতাম—তখন শুরু হত বকাবকি। ছেলেমানুষী কাজকর্ম আরকি। তো, পরপর কয়েকদিন এমন হওয়ার পর আমি চুপ করে আমাদের টেবিলে এসে দাঁড়িয়ে আছি। কেউ তেমন খেয়াল করেনি সেটা। তবে এ্যাঞ্জেলা মেয়েটার মধ্যে বোধহয় মমতার পরিমাণ একটু বেশি—মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো। এরপর বলল, সমস্যা নাই, মন খারাপ করিস না। যেদিন ল্যাব শেষ হবে, স্যারের দাড়িতে আমি আগুন ধরিয়ে দিবো, দেখিস!

বলার ভঙ্গিটা মজার ছিল, আমি অনেক্ষণ হেসেছিলাম।

আগুন দেয়ার আগেই অবশ্য একদিন দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আমরা ল্যাবের কাজ করছি, এমন সময় প্রচণ্ড শব্দে ফায়ার এ্যালার্ম বাজতে শুরু করলো। ল্যাবটা আবার আন্ডারগ্রাউন্ডে, কাজেই ফায়ার এস্কেপ দিয়ে বের হওয়ার সুযোগ নেই। বেরুবার একটাই রাস্তা। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে একে অন্যের দিকে তাকানোর পর আমরা তাড়াতাড়ি বের হলাম।

কেবল স্যার বের হলেন না। আমাদের সবাইকে বের করে দিয়ে কেন যেন আন্ডারগ্রাউন্ডে বসে থাকলেন। ইসিই ভবনের প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ বের হয়ে এসেছে—স্যার বের হননি।

শেষে আমরা ল্যাবে গিয়ে দেখি, স্যার চুপ করে টেবিলে বসে আছেন!

চাষী দীর্ঘসময় ধরে এই নিয়ে ঠাট্টা করেছিল। স্যার নাকি ল্যাবে বসেই আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। (ফাজলামো আরকি। স্যারের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই—ল্যাবে বসে থাকবেন আত্মহত্যা করতে। তবে স্যার আদৌ কেন বের হননি—জানিনা।)

বাহ! পরীক্ষার আগের রাতে দেখি স্রোতের মত লেখা আসছে। প্রিয় লেখা, এতদিন কোথায় ছিলেন? আমার যখন ছুটি চলে, তুমি কোথায় থাকো? ফাজিল কোথাকার। পরীক্ষার আগেরদিন সে আসে জন লেননের গানের মত, words are flowing out like endless rain into a paper cup! (অথৈয়ের খাতায় এই কথাটা লিখে দিয়েছিলাম—অনেকদিন পর মনে পড়ে গেল।)

এই লেখাটা পড়লে সবাই আমাকে পিটুনী দিবে। ফোন বন্ধ করে বসে আছি, সবাইকে বলেছি, খুব পড়ছি!

আসলেই পড়ছিলাম, কিন্তু সন্ধ্যা থেকে কেন যেন একেবারেই মন বসাতে পারছি না। হচ্ছে না, somehow.

সম্ভবত, এখানে আশ্রয়ের একটা ব্যাপার আছে। আমরা সবাই আশ্রয় খুঁজি। ক্লান্ত দিনশেষে প্রিয়মুখ, প্রিয় কথা—এইটুকু আমাদের বড় ভালো লাগে।

অথবা, এই যে দেখো, আমরা ঝড় আঁকতে পারি না, তবু যে প্রতিনিয়ত ঝড় বয়ে যায়—সেই ঝড়েও আমরা আশ্রয় খুঁজি।

আর আমার মত কিছু বোকা আছে, যারা আশ্রয় দিতে ভালোবাসে।

কিন্তু এই পৃথিবী বোকাদের জায়গা না। সজীব ভাই বলেছিল, সে বোকা। আর বোকারা সবসময়ই একা। কাজেই ‘আশ্রয়’ শব্দটাতে এসে আমি বরাবরই থমকে যাই।

এই যেমন দেখো, কালকে আমার টার্ম ফাইনাল। ডাটাকম কোর্সের স্যার নিজের মুখে বলেছেন, বই পড়লে তোমরা শেষ করতে পারবা না। প্লিজ বই পোড়ো না, লেকচার পড়ো, হয়তো কিছু মার্ক তুলতে পারবা। ক্লাসের সবাই পাগল হয়ে লেকচার পড়ছে। আবদুল্লাহ আমানের মত অসাধারণ একটা ছেলে বড় বড় চোখ করে বলছে, কীভাবে সম্ভব এই জিনিস পড়া?

অথচ আমি বসে আছি। ‘বসে আছি হে, কবে শুনিবো তোমার বাণী।’ এবং মোটামুটি নির্বিকার ভঙ্গিতেই বসে আছি।

এই ঘটনাকে, আমার এই নির্বিকারত্বকে আমি ঝড় হিসেবে define করতে চাই। আমার উঠোনে, আমার আঙিনায় যেটা বয়ে যাচ্ছে সেটা অবশ্যই একটা ঝড়। যেকোন দৃষ্টিকোণ থেকেই এটা ঝড়।

অথচ এই ঝড়ের রাতে, রাত দশটা একুশ মিনিটে বসে বসে আমাকে আশ্রয় নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।

আবার ঘুরেফিরে আগের প্রসঙ্গেই চলে আসছি। এই পৃথিবীতে দেবতাদের স্থান আছে, মানুষেরও আছে, কিন্তু প্রমিথিউসের নেই।

লেখা থামাই আপাতত। পাগলটা মেইল করেছে, কী এক কাহিনী করে বসে আছে আজ। ঠিক করেছি, খুব বকে দিবো আজ পাগলটাকে। ধাড়ি একটা মানুষ রিকশা চড়তে না শিখলে বড় মুশকিল। আমি কি এখন বসে বসে ওদেরকে রিকশায় চড়তে শেখাবো? তাই কি হয় কখনো?

ফোনে রিচার্জটা করি কেবল। পাগল আজ বেদম বকা খাবে।

পরিশিষ্ট ১: https://www.youtube.com/watch?v=hweeKdzyJgI
পরিশিষ্ট ২: https://www.youtube.com/watch?v=VJDJs9dumZI