চাঁদ নেমে আসে

“Everybody had a hard year
Everybody had a good time
Everybody had a wet dream
Everybody saw the sunshine
Oh yeah, oh yeah, oh yeah!”

গানটা হঠাৎ করে মাথায় ঢুকে গেছে। অবশ্য, গান মাথায় ঢোকে হঠাৎ করেই। অন্যদের ব্যাপারটা জানি না, আমার ক্ষেত্রে একেকটা গান মাথায় ঘুরতে শুরু করে, আর আশেপাশের সকল কিছুর সাথে সেটার একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায়।

যেমন, আজকে!

আজ দুপুরে (কিংবা সকালেও হতে পারে) মাথায় একটা বাক্য এসেছিল। কোথাও লিখে রেখেছিলাম, ‘সেই জানালা দিয়ে রাত্রিবেলা চাঁদ নেমে আসতো।’

এই একটা বাক্যই। এবং কী সুন্দর, এই বাক্যটার সাথেই গানটার সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেল।

Everybody had a hard year, everybody had a good time…।

ধরো, জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি কোনো এক সময়। বেশ গরম, মাথার ওপরে ঘোরলাগা বনবন শব্দে ফ্যানটা ঘুরছে। মাত্রই সন্ধ্যে পার হয়ে রাত নেমেছে। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে, কিছুক্ষণ আগে জেগে উঠেছো। ঘুম ভেঙে দেখলে, ঘরটা এলোমেলো, ঘুটঘুটে অন্ধকার। খোলা জানালা দিয়ে চাঁদ নেমে আসছে। তার আলো পড়ছে তোমার চোখেমুখে, সারা বিছানায়…

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা মানুষের কেমন অনুভূতি হয়?

আমি জানি না। তবে দৃশ্যকল্পটা আমাকে বারবার তাড়া করছে। একইসাথে মুগ্ধ করছে, একইসাথে বিষাদগ্রস্ত করছে।

কারণ, সেই জানালা দিয়ে রাত্রিবেলা চাঁদ নেমে আসতো।

এই সৌভাগ্যটুকু আমার হয়নি। আমরা যখন নিজেদের বাসায় আসি, তখন আমার বয়স বছর তিনেকের মত। অর্থাৎ প্রায় পুরো জীবনটাই আমি একই ঘরে বসে পার করেছি, এবং উত্তরখোলা জানালার ঘরে কখনই চাঁদ নামে না।

অনেক কিছুই মনে পড়ছে, অল্প অল্প করে।

Hard year, good time—এই সময়টা আমি নিজেও পার করেছি। আমার মনে আছে এক রাতের কথা। সেই রাতেও চাঁদ নেমেছিল। অবশ্যই আমার জানালায় না, কিন্তু পুরো শহরে।

কে জানে, হয়তোবা জৈষ্ঠ্যেরই কোনো এক রাত ছিল সেটা। সন্ধ্যে থেকেই টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। বিদ্যুতের লাইনে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয়েছিল, কাজেই চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঢাকা শহরে লোডশেডিং হলেও ছাই অন্ধকার হয়, কারণ ঘরে ঘরে আইপিএস থাকে। সেদিন বোধ করি সবার আইপিএস পর্যন্ত খেটেখুটে ঘুমিয়ে গিয়েছিল—ও বেচারারও তো সাধ্যের একটা সীমা আছে।

রাত দুটোয় আমি হঠাৎ জেগে উঠেছিলাম।

কিংবা, আমি জেগেই ছিলাম। তখন রাত দুটো বেজেছিল। এমনও হতে পারে।

ততক্ষণে বৃষ্টিটা ক্লান্ত হয়ে একটু থেমেছে। আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে, টুকরো টুকরো মেঘ। আমি বাইরে তাকিয়ে দেখি, আকাশভরা জোছনায় এই শহরের অন্ধকার দূর হয়ে যাচ্ছে। অনেক অনেকদিন পর, আমার শহরটা জোছনা গায়ে মাখছে। মেঘের গায়ে গায়ে, আমাদের সামনের বাসার দেয়ালে দেয়ালে, এলাকার সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাটার ওপরে জোছনা উপচে পড়ছে…

চাঁদের সাথে আমার সম্পর্কটা এমনই আসলে। অনেকটা দর্শকের। জোছনা আমার গায়ে পড়ে না। পড়ে অন্যের শরীরে, তবে আমাকে সাক্ষী রেখে।

এও কী অল্প ভাগ্যের কথা? হাস্নাহেনা তো কখনই তার সৌরভ পায় না, পায় অন্যেরা।

এবং এই সৌরভের মাঝে একটা রহস্য আছে। কতবার, এই শহরের কত রাস্তায় হেঁটে হাস্নাহেনার সৌরভ পেয়েছি। উৎস খুঁজে পাইনি। বছর তিনেকেরও বেশি সময় ধরে ধানমণ্ডি একের এক প্রান্তে এই ফুলের ঘ্রাণ পেতাম। রাস্তাটা ধরে হাঁটতে গিয়ে পাগল হয়ে যেতাম, কিন্তু বারবার ওপরে তাকিয়েও গাছটা খুঁজে পাইনি। আপনমনে হেঁটেই জায়গাটা পার হয়ে গেছি। সপ্তাহখানেক আগে একজন যদি নিজে থেকে গাছটা খুঁজে না দিতো, তবে আজও হয়তো সৌরভের উৎস অজানাই থেকে যেত।

একটা রহস্য থেকে যেত।

ব্যাপারটা খুব বেশি অদ্ভুত না? অন্য সবাই হাস্নাহেনার সৌরভ পায়, কিন্তু সৌরভের উৎস কোথায়—এই রহস্যের সমাধান করার ক্ষমতা তারই আছে—যাকে ঘিরে সৌরভের উৎপত্তি।

আমার ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি হিসেব মেলাতে পারছি না। হতেই পারতো, অন্য কেউ গাছটা খুঁজে বের করেছে। হতেই পারতো, কেউ খুঁজে পায়নি। কিন্তু ঠিকঠাক মানুষটার হাতেই হাস্নাহেনা ধরা পড়ল—এটা কীভাবে সম্ভব?

যার জানালা দিয়ে চাঁদ নেমে আসতো…

চাঁদ নেমে আসার এই ব্যাপারটা আমাকে বারবার মুগ্ধ করছে। আমাকে বিষাদ্গ্রস্ত করছে।

একটা গ্রীষ্মের সন্ধ্যা…

মাথার ওপরে ফ্যানটা ঘুরছিল, ভুতুড়ে একটা শব্দে…

এই দৃশ্যকল্পটা সম্ভবত কখনই ভুলবো না। দীর্ঘ একটা ভূমিকার পরে যেটা কল্পনায় রূপ পেয়েছে।

এবং ভুলবো না একটা দৃশ্য। কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই যেটা আমার চোখে ধরা পড়েছে।

সেখানেও একটা চাঁদ নেমে এসেছিল। সেখানেও আমি দর্শক ছিলাম, কারণ আমার গায়ে জোছনা পড়েনি। কিন্তু আমি দেখেছি, কতখানি মায়া নিয়ে চাঁদ নেমে আসে, কতখানি মমতা নিয়ে মানুষগুলোকে, এই পৃথিবীটাকে জড়িয়ে ধরে।

ভালোবাসা, আমার বাইশ বছরের তরুণ চোখকে আরও একবার সার্থক করার জন্য।

এবং ভালোবাসা, আমার বাইশ বছরের তরুণ কল্পনাকে আরও একবার মূর্ত করার জন্য।