শূন্যতাবোধের বৃত্তান্ত

[ফারহার জন্য নিষিদ্ধ। আগে এসএসসি শেষ কর বাঁদর।]

আমরা কেবল পূর্ণতাতেই ঋদ্ধ হই না, হই শূন্যতাতেও।

আমার মনে পড়ে, আজ থেকে প্রায় বছর দেড়েক আগে এক শূন্যতাবোধ আমাকে আক্রান্ত করেছিল। জীবনে প্রথমবারের মত। এই বোধের সাথে আমার পূর্বপরিচয় ছিল না—আমি তখন মাত্র একুশ বছর বয়সে পা রেখেছি—ভার্সিটি, কংগ্রেসের কাজকর্ম, বইপত্র, গান, আঁকাআঁকি, এবং চারপাশের অসম্ভব সুন্দর কিছু মানুষকে নিয়ে একটা পূর্ণতা অনুভব করার চেষ্টা করছি—ঠিক সেই মুহূর্তেই পা হড়কে গেল। প্রপাত ধরণীতল হলে তবু সামলে নিতে পারতাম, আমি পড়লাম অতল জলে।

গভীর সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার অনুভূতিটা খুব একটা সুখকর না। কাজেই আমি প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করলাম। এক রাত উদ্‌ভ্রান্তের মত লিখলাম। পরক্ষণেই সব কেটে দিলাম। পরদিন খ্যাপার মত ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে থাকলাম। কখনো রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম, বৃষ্টিধোয়া বিকেলে ক্যাম্পাসজুড়ে অকারণেই হাঁটলাম। কাজকর্ম ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হল, গল্পের বই ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে হল। সবকিছু হারানোর স্পষ্ট একটা অনুভূতি আমার ভেতরটা একেবারে ফাঁপা করে দিয়েছিল।

আমার আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, ঠিক সেই মুহূর্তে আমি কী মনে করে ভূমিকার অসমাপ্ত ছবিটা বের করেছিলাম। মাসের পর মাস ধরেও যেই ছবি আমি আঁকতে পারিনি—সেটা দুদিনের মাথায় শেষ হয়ে গেল, চোখের পলকে দাঁড়িয়ে গেল। লজ্জার মাথা খেয়ে বলছি, পরবর্তীতে সেই ছবি দেখে আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেছি, বিহ্বল হয়ে খানিকক্ষণ ঘরের কোণে একা বসে থাকতে ইচ্ছে হয়েছে।

আমাকে বৃষ্টিতে পেয়েছিল, আমাকে পেনসিলে পেয়েছিল। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, অমন করে টানা ক’টা দিন বৃষ্টি নামানোর জন্য। সকালবেলা ক্লাসে গিয়ে আমি আঁকতে বসতাম, আর বাইরে ঝুম বৃষ্টি নামতো। যখন বৃষ্টি ধরে আসতো, আমি বারান্দার জানালা দিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। সার্শিতে বসে ছবি আঁকতাম। কখনো হালকা বৃষ্টির ছাঁট আসতো—গ্রাহ্য করতাম না আমি। সেই জানালা সবসময়ই তালাবন্ধ থাকতো, ঠিক ছবি আঁকার প্রয়োজনেই যে তালা খোলা পেলাম—এ-ও কি সৃষ্টিকর্তার অশেষ লীলা না? ফুরায়ে ফেলে আবার নব নব জীবন ভরার জন্যই কি তিনি এমনটা করেন?

হয়তোবা। কিন্তু আমার সময় তখনো আসেনি।

ছবিটা আমাকে বিহ্বল করলেও, শূন্যতাবোধকে দূর করতে পারলো না। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার রসদ জোগালো। আবারও টুকটাক লিখতে শুরু করলাম, হঠাৎ করেই অঞ্জনের গানগুলো ভালো লাগতে শুরু করলো। ভার্সিটির টার্ম প্রজেক্টের কাজেও হাত দিলাম বটে, এবং ফাহিম ছেলেটার সাথে প্রজেক্টে কাজ করে এতটাই আনন্দ পেলাম যে, সেই আনন্দ ক্লাসমেটদের পার করে গম্ভীরমুখো স্যারদের পর্যন্ত স্পর্শ করলো।

কিন্তু না, আমার সময় তখনো আসেনি।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন সন্ধ্যায় ভার্সিটি থেকে একটা ল্যাব ফাইনাল দিয়ে বেরিয়েছিলাম। ব্যাগের ভেতরে একটা চিঠি ছিল। সেই চিঠি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের সামনে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। দোয়েল চত্বরের সেই রাস্তাটা মোটামুটি ফাঁকাই ছিল সেদিন, আর রাস্তার ঠিক মধ্যিখানে কাগজগুলো ঝরা পাতার মত ভাসতে ভাসতে নিচে পড়ছিল।

ভুতুড়ে, কারণ নিজের অজান্তেই আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার সবকিছুই ত্যাগ করতে হবে। সাধের উকুলেলেটা পর্যন্ত এক সন্ধ্যায় পদ্মদের বাসায় রেখে এলাম।

এতে যে খুব একটা আপত্তি ছিল—তা-ও না। আমার যে সব দিতে হবে, সে তো আমি জানি।

শেষে দেখলাম…

আমি যেখানে এসে পড়েছি, সেটা নিতান্তই একটা বিজন ঘর, সেই ঘরে নিশীথ রাত, শূন্য হাত, আর থাকার মধ্যে এক কেবল হৃদয়টা ছাড়া আর কিছুই নেই আমার।

বাইরে আলো থাকলে মানুষ চোখের আলোয় দেখে, চোখের বাইরে। সেই আলো নিভে গেলে অন্তরে দেখা ছাড়া গতি থাকে না। সুতরাং আমাকে হৃদয়ের গভীরতম অংশ দিয়ে সবকিছু দেখতে হল। ইচ্ছে অনুসারে না—প্রয়োজনের খাতিরে।

এবং কী সুন্দর, আমি দেখলাম, আমারই চারপাশে অসংখ্য মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, অসম্ভব পবিত্র কিছু হৃদয় নিয়ে। সেই আলোয় আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত পবিত্র হতে শুরু করলো, আমি আবার নতুন করে জীবন ফিরে পেলাম। আমার ইচ্ছে হল মানুষগুলোর হাত ধরি, প্রচণ্ড জোরে ওদেরকে টেনে ওপরে তুলি, ওদের ভেতরের চোখ খুলে দেই, ওদেরকে দেখাই, তারা কী অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে একেকজন!

আমি ওদের হাত ধরলাম। এবং শূন্যতাবোধটুকু আমাকে ঋদ্ধ করতে শুরু করলো। আমি যখন বললাম, আমার কিচ্ছু চাই না—ঠিক তখনই জীবন আমাকে দু হাত ভরে দিতে শুরু করলো।

ব্যাপারটা কি করুণ রসাত্মক? আমরা কি এইবেলা হাসিমুখ নিয়েও সংস্কারবশে দু-একজন ভ্যাক করে কেঁদে ফেলবো?

আমাকে না, জীবন পাগলের মত সবকিছু দিতে শুরু করলো। আমি হাতজোড় করে, কান ধরে বললাম, ক্ষ্যামা দে মা, আমার দরকার নেই এতখানি পাওয়ার! কোথায় কী। যতখানি প্রাপ্য তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসা আমাকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মমতার সেই স্রোতে আমি খড়কুটোর মত ভেসে গেলাম।

খড়কুটো খুব একটা ভালো কিছু না। জলে ভেসে যাওয়াটাও বাহবা দেয়ার মত কিছু না। শেকড় ছেড়ে যে একবার ভেসে পড়ে—তার আজীবন ভেসে যেতেই ইচ্ছে করে। মমতার স্রোতে ভেসে পড়ার চেয়ে সুখের আর কী আছে? সুতরাং ভেসে যাওয়া খড়কুটো কেবল চায়, চায়, প্রাণপণে স্রোতের ঢল চায়।

এবং সে ভেসে যাবে, যদি না সেই স্রোত শুকিয়ে মরুতে পরিণত হয়।

আমি কি অমনই একটা মরুতে এসে পড়েছি?

জানি না। বিন্দুগুলো জোড়া দেয়ার জন্য পেছনে ফিরে তাকাতে হয়—সেই সময় এখনো আসেনি। কেবল এটুকু জানি যে, বাইশটা বছর পার করার পর যখন,

‘হঠাৎ ফিরে দেখি
নিজের মুখোমুখি—
শূন্য, ভীষণ শূন্য মনে হয়…’

অকপটে স্বীকার করছি, তাই যদি হয়, তবে আমি আগ্রহী।

কেননা, আমরা কেবল পূর্ণতাতেই ঋদ্ধ হই না, হই শূন্যতাতেও।