গোর

....পদ্মর নানাভাইয়ের কবরের পাশের গাছটা খুঁজে পেতেই কবরটাও সহজেই খুঁজে পেলাম। 

এবং, সেই কবরের মাথায় দেখি একটা এপিটাফ, নানাভাইয়ের নাম লেখা। পাথরে খোদাই করা না হলে কি সেটাকে এপিটাফ বলে ডাকা যায়? হয়তোবা ওটাকে এপিটাফ বলে না, হয়তোবা ওটাকে সাইনবোর্ড বলেই ডাকে সবাই। আবার হয়তো ওটাকে কিছুই ডাকে না। আমি এপিটাফ বলেই ডাকবো।

তো দেখি যে, এপিটাফটায় আনুষ্ঠানিক কিছু কথাবার্তা লেখা, কিছু দোয়া-দরুদ। এবং কিছুক্ষণের মাঝেই আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই গোরস্থানে এপিটাফের একটা ফরম্যাট আছে। দেখেই বোঝা যায়, কিছু আছে কমদামি এপিটাফ—ওগুলোতে এক ধরনের লেখা। আরেকটু দামি এপিটাফ হলে আরেক ধরনের লেখা। সবগুলোর ফরম্যাট একই, কেবল কেউ মারা গেলে সেখানে মৃত ব্যক্তির নাম আর তারিখ বসিয়ে দেয়া হয়।

এবং এরও কিছুক্ষণ পর, আরও আশ্চর্যের একটা জিনিস খেয়াল করলাম। পদ্মর নানাভাইয়ের পাশে আরেকটা কবর—আমার ঝাপসা মনে আছে, যেই রাতে নানাভাইকে কবর দেই তখন এ জায়গাটা ফাঁকা ছিল। খেয়াল করে দেখলাম, মাত্র দিনদশেক আগে এক ব্যক্তি মারা গেছে, ওনাকে মাটি দেয়া হয়েছে এখানে।

কিন্তু আশ্চর্য এই যে, দশ দিনেই সেই কবরের ওপরের ঘাস জীর্ণ হয়ে শুকিয়ে গেছে—পদ্মর নানাভাইয়ের কবরের সতেজ ঘাসের দিকে তাকালে সেটাকেই বরং নতুন মনে হয়।

কারণটা খুঁজে পেতেও বেশি সময় লাগলো না। দেখলাম, গোরস্থানের কর্মচারীদের একটা দায়িত্ব হল নিয়মিত কবরগুলোতে পানি দেয়া। অর্ধেক কবরেই অবশ্য পানি দেয়া হচ্ছে না, দেয়া হচ্ছে কেবল নির্দিষ্ট কিছু কবরে।

আমি ভাবছি, এপিটাফের ফরম্যাটের মত এই কাজের জন্যও কি গোরস্থান-কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট কিছু প্যাকেজ আছে? হয়তো আছে। ব্যাপারটা হয়তো দোষেরও না, কেউ যদি তার প্রিয়জনের কবরে সুন্দর একটা এপিটাফ দিয়ে চারপাশে ক’টা ফুলগাছ লাগিয়ে দিতে চায়, নিয়মিত কবরের ওপরে পানি দিতে চায়—তাহলে গোরস্থান-কর্তৃপক্ষের সাথে সমঝোতা করে এই কাজগুলো করতেই পারে।

কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে পুরো ব্যাপারটাকে আমি দেখছি আমাদের শহুরে যান্ত্রিকতার একটা নিদর্শন হিসেবে।

আমি চাই না আমার মৃত্যুর পর কেউ গোরস্থানের কর্তৃপক্ষের সাথে বসুক। আমি চাই না, আমার প্রিয়জনের সামনে একটা লিফলেট মেলে ধরা হোক—যেখানে লেখা থাকবে কোন ধরনের এপিটাফের জন্য কেমন খরচ। আমি চাই না, আমার প্রিয়জন তার আর্থিক অবস্থা এবং গোরস্থানের খরচকে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে ঘোষণা দিক, এই কবরে আমি বিশটা ফুলগাছ, এক বস্তা দূর্বাঘাস এবং দুইদিন অন্তর পানি চাই।

এবং আমি জানি, আমি কী চাই।

আমি যে চাই—সেটা বুঝেছি গতকালের সুন্দরতম দৃশ্যটার মুখোমুখি হওয়ার পর। গোরস্থানে কর্মচারীরা গাছগুলোতে পানি দিয়ে যাচ্ছিল বিদ্‌ঘুটে একটা যন্ত্র দিয়ে। বাগানের মালীদের হাতে অমন পানি দেয়ার একটা যন্ত্র দেখা যায়। তো, সেই কর্মচারীদের মোটামুটি উপেক্ষা করে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক গোরস্থানে ঢুকলেন পাঁচ লিটারের বিশাল এক বোতল নিয়ে। মোটামুটি শেষ প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে একটা কবরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আপনমনে সেখানে পানি দিতে শুরু করলেন।

আমি প্রথমে খেয়াল করিনি। করলাম তখন, যখন গোরস্থানের এক কর্মচারী সেই বুড়োকে ডাকতে শুরু করল। কী যেন জিজ্ঞেস করেছিল সে, দূর থেকে আমি ঠিক শুনতে পাইনি। তবে বুড়োর গলায় জোর ছিল বটে, অতদূর থেকেও তার উত্তরটা বোঝা গেল। সে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে কবরটা দেখিয়ে বলল, ‘এইখানে আমার স্ত্রী আছে।’

কোনোরকম ভনিতা না করেই বলতে চাই, আমার উত্তরটা ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে এই কারণে যে, বুড়ো বলেনি, ‘এটা আমার স্ত্রীর কবর,’ বরং বলেছে, ওখানে তার স্ত্রী আছে। তার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে মনে হবে, ব্যাপারটা খুবই সাধারণ—তার স্ত্রী সেই জায়গায় থাকে তো, কাজেই সে পানি দিচ্ছে।

মমতার এই খেলাটুকু আমার ভালো লেগেছে। বুড়োর স্ত্রী নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান একজন মানুষ। আর যাই হোক, অন্তত প্রিয়জনের স্পর্শটুকু পাচ্ছেন তিনি, ভাড়া করা মানুষ এসে কবরে পানি ঢেলে যাচ্ছে না।

আমি, আমরা সবাই কি এমনটাই চাই না?

এবং বলে ফেলার লোভ সামলাতে পারছি না, বড় ইচ্ছে করে, আমার কবরের আশেপাশে একটা শিউলী গাছ থাকুক। জানি না, হয়তো আম্মুর নামের কারণেই এই গাছটার প্রতি আমার আলাদা একটা মমতা আছে। মায়া আছে এর ঘ্রাণের ওপরেও। সুতরাং আমার ইচ্ছে করে, শীতের রাতে শিউলী ফুলের ঘ্রাণ কবরের দশদিকে ছুটে যাক, সবাইকে পাগল করে দিক। আমার ইচ্ছে করে, প্রতি সকালে শিশিরভেজা মাটিতে সেই ফুল ঝরে পড়ুক। আজিমপুর গোরস্থানের মত তুলে আনা কৃত্রিম ফুল না, সত্যিকারের শিউলী ফুল মাটিতে ঝরে পড়ুক, আর তার দু-একটা উড়ে আসুক আমার কবরের দিকে।

হুম, আরেকটু!

খানিক্ষণ আগেই বলেছি, গতকাল গোরস্থানে হাঁটার সময় আমি ভাদ্রের রাতের বাতাস পেয়েছি। সেই বাতাস কেবল আমাকে না, আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি বসে থাকা গাছের ডালপালাকেও নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। আর গাছগুলো থেকে বৃষ্টির মত পাতা ঝরছিল। ঝুম বৃষ্টি না, টাপুরটুপুর বৃষ্টি। আমার গায়ে, কবরগুলোর ওপরে…

কেন যেন ইচ্ছে করে, রোদলাগা সকালগুলোতে আমার কবরে ঠিক এভাবেই শুকনো পাতা, টুকরো ফুল ঝরে পড়ুক। ঝরা পাতার একটা মায়া আছে, সেই ঘোরলাগা শব্দ আমাকে আক্রান্ত করুক, আমি চাই। সেই গানটার মত,

“সে বুঝি শুয়ে আছে চৈত্রের হলুদ বিকেলে
সেখানে চূর্ণফুল ঝরে তার আঁচলে
সেখানে চূর্ণফুল ঝরে তার কাফনে।”

বুড়োকে পার হয়ে আরও অনেকখানি সামনে এগিয়ে এলাম। অনেক পুরনো কিছু কবর আছে, বাঁধাই করা—কেবল চারপাশে না, ওপরেও। রীতিমত ঘরই বানিয়ে ফেলা হয়েছে দু-একটা কবরকে ঘিরে।

অমনই একটা ঘর চোখে পড়লো। বেশ পুরনো, পঞ্চাশের দশকের হলেও খুব বেশি আশ্চর্য হব না। ঘরটার জীর্ণ অবস্থা—ছাদ, দেয়াল প্রায় পড়ো-পড়ো। মনে হল, আমি গিয়ে হালকা একটা ধাক্কা দিলেই পুরো ঘরটা ধসে পড়বে।

তবু, ঘরটা কোনো এক কারণে সুন্দর। ধুলোবালি মাখা বটে, কিন্তু অপরিষ্কার না। ভেতরে দুটো কবর। চারদিক-ঘেরা জানালা দিয়ে কবর দুটোতে রোদ পড়ছে, সকালবেলার বাতাস ঢুকছে।

ব্যাপারটা দেখে একধরনের আধিভৌতিক অনুভূতি হল। আচ্ছা, মরে যাবার পর মানুষের কি কোনো বোধ থাকে? তারা কি বুঝতে পারে তারা কোথায় আছে?

ঘরটা সুন্দর, আমি যেমন দেখেছি শীতের সকালের রোদ ঢুকতে, তেমনই শ্রাবণের কোনো রাতে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলে সেই ঘরে জোছনাও ঢুকবে।

সুতরাং আমার ভাবতে ইচ্ছে করে, এই কবর দুটো আদৌ কাদের। কেন এতখানি মমতা দিয়ে এদেরকে একই ঘরে পাশাপাশি মাটি দেয়া হয়েছে।

আমার জানতে ইচ্ছে করে, ওদের কোনো বোধ আছে কিনা। সারা সন্ধ্যা বৃষ্টির পর মধ্যরাতে যখন এক চিলতে জোছনা এসে সেই ঘরে ঢোকে—তখন তারা উঠে বসে কিনা, জীর্ণ দেয়ালটায় হেলান দিয়ে অস্পষ্ট ভঙ্গিতে সবকিছু উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে কিনা....

[২২ জানুয়ারি, ২০১৮-এর ডায়েরির কিছুটা অংশ সরাসরি এখানে তুলে দিয়েছি। যেহেতু আগে-পরের অর্ধেকের বেশি লেখা বাদ গেছে, সুতরাং একটু খাপছাড়া লাগতে পারে। গাধা ব্যতীত অন্যান্য সম্প্রদায়ের কাছে এই ব্যাপারে ক্ষমাপ্রার্থী।]