ব্রহ্মার পুত্র, ব্রহ্মার কন্যা


[আরিফের জন্য মৃদু সতর্কবার্তা। ফারহার জন্য ছয় নম্বর বিপৎসংকেত। বাকিদের সমস্যা নেই।]

গতকাল ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম। গাধাটা ক’দিন ধরে বেশ মনটন খারাপ করে বসে আছে। ভাবলাম, আমরা দু-একজন আড্ডা দিয়ে আসলে ভালো কিছু হতে পারে। পরিকল্পনা ছিল যে, গতকাল আমি যাব, আর আজ-কাল আরেকজন যাবে।

প্রায়ই পাগল দুটোকে যখন বিদায় দিয়ে বাসে তুলে দেই, তখন মনে হয়, দুম করে বাসে উঠে ময়মনসিংহ চলে যেতে পারলে মন্দ হত না। কে জানে, সেকারণেই গতকাল বাসে চড়ে বসতে এত বেশি ভালো লেগেছিল কিনা!

এবং ময়মনসিংহ নেমেও কেন যেন বড় ভালো লাগলো। অটোতে করে নিজেই শহরের রাস্তাগুলো খুঁজতে গিয়ে পুরো শহরটাকে হঠাৎ করেই খুব বেশি আপন মনে হল—যতখানি আগে কখনই হয়নি।

এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই, অটোতে বসে ঠিক করলাম যে, রিয়াকে ফোন দিয়ে বলবো, খুব খিদে পেয়েছে, যেন দুপুরে একটু খেতে দেয়!

টাউন হলে এসে নেমে পড়লাম। শীতের দুপুরে মোড়টা দেখতে বড় সুন্দর লাগছিল। ওপাশে একটা হলদে রঙের দোতলা বাড়ি আছে—সেটার গায়ে যখন রোদ পড়ে—মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। আমি কলেজের পাশের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে রিয়াকে ফোন দিলাম। গাধাটা রীতিমত কানফাটানো একটা চেঁচানি দিল, ‘আল্লাহ, ভাইয়া তুমি কোথায়? বেশি ঘুইরো না, হারায়ে যাবা! একটা রিকশা নিয়ে বাসায় চলে আসো!’

আমি ফোন রেখে বিড়বিড় করে বললাম, গাধা। আমি নাকি হারায়ে যাবো।

বাসায় গিয়ে ভালো লাগলো, অনেকদিন পর আন্টির সাথে বকবক করতে পেরে। প্রায়ই ভাবি, আন্টিটাকে ফোন দিব, কিন্তু এই দিব-দিব করে শেষ পর্যন্ত আর দেয়া হয় না। আমি হিসেব মেলাতে পারছিলাম না, শেষে আন্টিই হিসেব করে বের করল যে, শেষবার পদ্মদের বাসায় দেখা হয়েছিল ওনার সাথে। সেও প্রায় মাস চারেক আগের কথা—এই মাঝের সময়টুকুতে যা গেল—ওতে দেখা করার আর সুযোগ হয়নি।

আমার উকুলেলেটা ছিল রিয়ার কাছে। ওদের কাজই তো আমাকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা করা—এই যন্ত্রণার নতুনতম পন্থা হল, আমার উকুলেলে নিয়ে বাসায় চলে যাওয়া, এবং একটু পরপর ফোন দিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে আমাকে সেটা বাজিয়ে শোনানো। আমি এদিকে কিছু বাজাতে না পেরে আঙুল কামড়াচ্ছি, আর ওদিকে বদের হাড্ডিটা সারাদিন ধরে C-Am-G-F প্রগ্রেশনটা তুলে যাচ্ছে। ফোনে সেই প্রগ্রেশন শুনে আমার রীতিমত মাথা নষ্ট হওয়ার মত অবস্থা (সিরিয়াসলি, লিখতে গিয়েও আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে—মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে বাজাতে না পারলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে)!

গান কি এভাবেই মানুষের মধ্যে নেশা ধরিয়ে দেয়?

ভালো লাগছিল—গতকাল খাবার পর আমি আপনমনে সলো তুলছিলাম—আর প্রতিটা নোটের সাথে রিয়া-রাইয়ানের মুখভঙ্গি পাল্টে যাচ্ছিল। wonderful tonight গানের মূল রিফের মত করে একেকটা নোট বেন্ড করছিলাম, আর প্রতিটা বেন্ডের সাথে দুই ভাইবোন অদ্ভুতভাবে চোখ-মুখ-ভুরু নেড়ে যাচ্ছিল। অর্থাৎ সলোটা যে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে—সেটা দুজনেই বুঝতে পারছে।

ব্যাপারটা সুন্দর না? রাইয়ানের মত পিচ্চি থেকে শুরু করে রিয়ার মত তরুণ, কিংবা পদ্মর নানু পর্যন্ত সবাই এই সুরের ভাষাটা বোঝে। হাজার হাজার শব্দ খরচ করেও যেই অনুভূতিটা বোঝানো যায় না—সেটা wish you were here-এর একটা গিটার রিফ দিয়ে বলে ফেলা যায়।

আচ্ছা এসব কথা থাক আপাতত। গতকালের ঘটনা বলি।

রাতের মধ্যেই বাসায় ফিরতে হবে, কাজেই দুপুর তিনটের দিকে আমি রীতিমত হুড়মুড় করে উঠে পড়ার চেষ্টা করলাম। টঙ্গীর জগদ্বিখ্যাত জ্যামের কথা কে না জানে। আমার হুড়োহুড়ি দেখে রিয়া-রাইয়ান প্রথমে অনুরোধ করে এবং এরপরে বকা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলো। ওতে যখন কাজ হল না, তখন রাইয়ান পিচ্চিটা তার মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করল। চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে আদুরে ভঙ্গিতে বলল, দুপুরে রওনা দিলে আমি নাকি সন্ধ্যাতেই পৌঁছে যাবো। আর ঠিক বিকেল পাঁচটায় রওনা দিলে পৌঁছাবো রাত আটটায়। ব্যাটা এত সুন্দর করে কথাগুলো বলল—আমি বিশ্বাসও করে ফেললাম। এমনই বিশ্বাস করে ফেললাম যে, বাসায় কিছুক্ষণ এবং ছাদে আরও কিছুক্ষণ আড্ডা দিতে, খানিকক্ষণ রিকশায় ঘুরতে, একটুক্ষণ জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা দেখতে, এবং অনেকক্ষণ ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও আমার কোনো আপত্তি থাকলো না!

তবে স্বীকার করছি, পাগলামোটুকু একশোভাগ, এবং তার ওপরে আরও কিছুটা যদি থাকে—তবে ততটুকুই সার্থক হয়েছে। রিয়া যখন বলল, চলো জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহশালা দেখাই—তখনও আমার মাথায় পুরো জিনিসটা ধরা পড়েনি। গ্যালারিতে ঢোকার ঠিক আগমুহূর্তে মনে পড়ে গেল—কী সর্বনাশ, জয়নুলের নিজের হাতে আঁকা পঞ্চাশটার মত ছবি এই গ্যালারিতে আছে, এবং আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল এই ছবিগুলো দেখার!

(ব্যাপারটা অদ্ভুত না? মাত্র একবেলা ময়মনসিংহ ঘুরেই আমি লিখে শেষ করতে পারছি না। এরপর যদি নেত্রকোণা-চট্টগ্রাম নিয়ে লেখা শুরু করি—তখন কী হবে?)

সংগ্রহশালার সামনের জায়গাটুকুও অসম্ভব সুন্দর। একটা জায়গা যতখানি সুন্দর হলে সেখানে রিয়া এসে চুপ করে বসে থাকে, মন খারাপ হলে ছবি আঁকে, এবং ওপর থেকে কড়ই গাছের হলুদ পাতা ঝরতে দেখে—ঠিক ততখানি সুন্দর জায়গাটা। সামনে একটা মাঠ, একটা বাঁধানো মঞ্চ। কে জানে কত পুরনো মঞ্চটা? আর কিছু না হোক, কেউ সেখানে এসে বসে থাকলে এমনিতেই মন অর্ধেক ভালো হয়ে যাবে।

একপাশে ব্রহ্মপুত্র—চুপ করে বসে থাকলে নদটার কথা শোনা যায়। চাইলে আড্ডাও দেয়া যায় নদের সাথে।

রিয়া দেয় মাঝেমধ্যে। আমাকে বলেছে।

যে দোতলা বাড়িটাকে আশ্রয় করে সংগ্রহশালাটা গড়ে উঠেছে—সেটা প্রায় শ’খানেক বছরের পুরনো। ব্রিটিশ আমলের কোনো এক সাহেব এই বাড়িটাতে থাকতেন। কয়েক হাত ঘুরে বাড়িটা আজকের অবস্থায় এসেছে। তবু, ভেতরে ঢুকলে আদিমকালের একটা অনুভূতি হয়। নিচতলায় একটা ঘর আছে—ঘরের একপাশে ছোট্ট একটা মঞ্চ। মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে আমি যখন উকুলেলেতে একটা-দুটো নোট তুলছিলাম, পুরো ঘরটা রীতিমত গমগম করছিল—এত ভালো লাগে শুনতে! কে জানে, একশো বছর আগে ইংরেজ ব্যাটা এখানে বসে আপনমনে সুর তুলতো কিনা।

হয়তো তুলতো। একশো বছর আগেও অমনই ব্রহ্মপুত্র বয়ে যেত বাড়িটার পাশ দিয়ে। একশো বছর আগেও একটা মেয়ে এসে কড়ই গাছটার নিচে বসে থাকতো। সোনালি-হলুদ পাতার বৃষ্টি ঝরে পড়তো তার গায়ে।

বাড়িটার সামনে দাঁড়ালেই নদ দেখা যায়, আমি সেখান থেকেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। মুগ্ধতাটুকু আরেকটু বেড়ে গেল ব্রহ্মপুত্রের চরে নামার পর। কিছুদিন আগেও নদটার পাশ দিয়ে হেঁটেছি, কিন্তু এখানে যে এত সুন্দর চর আছে—আগে চোখে পড়েনি। অন্যপাড়ে নদ ভাঙছে। শেষবিকেলের আলোয় সেই পাড়ে, ওদিকের গাছগুলোতে যেন আগুন ধরে গেছে।

বছরখানেক আগে যখন পদ্ম এসেছিল, ওরা সবাই নাকি সুরভী আন্টির বকা উপেক্ষা করে ঠিক এই জায়গাতেই পানিতে দাপাদাপি করেছিল। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে।

এবারও শীত ছিল বটে। ব্রহ্মপুত্রের বাতাস রীতিমত কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল। তবু, একটা কথা বলব বলব করেও আমি যখন বললাম না, তখন রিয়া নিজেই ইতস্তত করে সেটা জিজ্ঞেস করে ফেলল।

বলল, এখানে খালিপায়ে না দাঁড়ালে ব্রহ্মপুত্রের অপমান হবে কিনা।

ব্যাপারটা মজার না? গঙ্গার পুত্রকে ব্রহ্মার কন্যা জিজ্ঞেস করছে, ব্রহ্মার পুত্রকে কীভাবে শ্রদ্ধা জানাতে হয়।

আমার কী সাধ্য—তুচ্ছ আমি—আমার কি সাধ্য ব্রহ্মপুত্রকে অপমান করি?

সুতরাং, গায়ে চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে সেই শীতের বিকেলে আমি পানিতে নেমে পড়লাম।

জীবনের বাইশ বছর, দীর্ঘ বাইশটা পর প্রথমবারের মত ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র স্পর্শ আমাকে ধন্য করল।