পোস্টগুলি

শূন্যতাবোধের বৃত্তান্ত

ছবি
[ফারহার জন্য নিষিদ্ধ। আগে এসএসসি শেষ কর বাঁদর।] আমরা কেবল পূর্ণতাতেই ঋদ্ধ হই না, হই শূন্যতাতেও। আমার মনে পড়ে, আজ থেকে প্রায় বছর দেড়েক আগে এক শূন্যতাবোধ আমাকে আক্রান্ত করেছিল। জীবনে প্রথমবারের মত। এই বোধের সাথে আমার পূর্বপরিচয় ছিল না—আমি তখন মাত্র একুশ বছর বয়সে পা রেখেছি—ভার্সিটি, কংগ্রেসের কাজকর্ম, বইপত্র, গান, আঁকাআঁকি, এবং চারপাশের অসম্ভব সুন্দর কিছু মানুষকে নিয়ে একটা পূর্ণতা অনুভব করার চেষ্টা করছি—ঠিক সেই মুহূর্তেই পা হড়কে গেল। প্রপাত ধরণীতল হলে তবু সামলে নিতে পারতাম, আমি পড়লাম অতল জলে। গভীর সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার অনুভূতিটা খুব একটা সুখকর না। কাজেই আমি প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করলাম। এক রাত উদ্‌ভ্রান্তের মত লিখলাম। পরক্ষণেই সব কেটে দিলাম। পরদিন খ্যাপার মত ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে থাকলাম। কখনো রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম, বৃষ্টিধোয়া বিকেলে ক্যাম্পাসজুড়ে অকারণেই হাঁটলাম। কাজকর্ম ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হল, গল্পের বই ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে হল। সবকিছু হারানোর স্পষ্ট একটা অনুভূতি আমার ভেতরটা একেবারে ফাঁপা করে দিয়েছিল। আমার আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, ঠিক সেই মুহূর্তে আমি কী মনে করে ভূমিকার অস...

গোর

ছবি
....পদ্মর নানাভাইয়ের কবরের পাশের গাছটা খুঁজে পেতেই কবরটাও সহজেই খুঁজে পেলাম।  এবং, সেই কবরের মাথায় দেখি একটা এপিটাফ, নানাভাইয়ের নাম লেখা। পাথরে খোদাই করা না হলে কি সেটাকে এপিটাফ বলে ডাকা যায়? হয়তোবা ওটাকে এপিটাফ বলে না, হয়তোবা ওটাকে সাইনবোর্ড বলেই ডাকে সবাই। আবার হয়তো ওটাকে কিছুই ডাকে না। আমি এপিটাফ বলেই ডাকবো। তো দেখি যে, এপিটাফটায় আনুষ্ঠানিক কিছু কথাবার্তা লেখা, কিছু দোয়া-দরুদ। এবং কিছুক্ষণের মাঝেই আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই গোরস্থানে এপিটাফের একটা ফরম্যাট আছে। দেখেই বোঝা যায়, কিছু আছে কমদামি এপিটাফ—ওগুলোতে এক ধরনের লেখা। আরেকটু দামি এপিটাফ হলে আরেক ধরনের লেখা। সবগুলোর ফরম্যাট একই, কেবল কেউ মারা গেলে সেখানে মৃত ব্যক্তির নাম আর তারিখ বসিয়ে দেয়া হয়। এবং এরও কিছুক্ষণ পর, আরও আশ্চর্যের একটা জিনিস খেয়াল করলাম। পদ্মর নানাভাইয়ের পাশে আরেকটা কবর—আমার ঝাপসা মনে আছে, যেই রাতে নানাভাইকে কবর দেই তখন এ জায়গাটা ফাঁকা ছিল। খেয়াল করে দেখলাম, মাত্র দিনদশেক আগে এক ব্যক্তি মারা গেছে, ওনাকে মাটি দেয়া হয়েছে এখানে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, দশ দিনেই সেই কবরের ওপরের ঘাস জীর্ণ হয়ে শুকিয়...

হার্ট অফ গোল্ড

ছবি
নিল ইয়াং-এর একটা গান ছিল, I was searching for a heart of gold, and I’m getting old. আচ্ছা, হার্ট অফ গোল্ড আদৌ কী? মানুষ কেন এটা খোঁজে? ওরা কি সেই হরিণের মত, যে নিজের কস্তুরীর ঘ্রাণে পাগল হয়ে যায়, বনে বনে সেই ঘ্রাণের উৎস খুঁজে বেড়ায়? কেনই বা মানুষ বৃদ্ধ হয়ে যায়? ওরা কি রবিবাবুর কবিতার সেই খ্যাপা, যে সারাজীবন পরশপাথরের খোঁজে ছুটে বেড়ায়? হয়তো…হয়তো। তৃতীয় চোখটা খুলে গেলেই মানুষগুলো হরিণ হয়ে যায়, ওরা খেপে যায়। হৃদয়ের শুদ্ধতম অংশটুকু খোঁজার জন্য ওরা গভীর থেকে গভীরে ডুব দেয়। ডিপ ইনসাইড, প্রতিটা মানুষই কি সুন্দর না? তবু কেন আরেক দল মানুষ খোলস নিয়ে ব্যস্ত থাকে? হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছোবার আগে খোলসটাই চোখে পড়ে—এজন্যই কি? আমার মন ভালো নেই। কাছের কিছু মানুষের খোলস-সাজানো দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত, এবং হতাশ। ওরা আগ্রহের সাথে ঘ্রাণ মাখে, তীব্র উৎসাহে রঙ লাগায়, চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকে। আচ্ছা, আমার দাদুবাড়ির শিউলী গাছটা যদি ‘ইভনিং ইন প্যারিস’ মেখে বসে থাকতো, তবে ভালো হত না? শিউলীর হালকা ঘ্রাণ তো ভোরের বাতাসেই হারিয়ে যায়, কড়া সুগন্ধী মাখলে সবাই নিশ্চয়ই ঘুরে ...

চাঁদ নেমে আসে

ছবি
“Everybody had a hard year Everybody had a good time Everybody had a wet dream Everybody saw the sunshine Oh yeah, oh yeah, oh yeah!” গানটা হঠাৎ করে মাথায় ঢুকে গেছে। অবশ্য, গান মাথায় ঢোকে হঠাৎ করেই। অন্যদের ব্যাপারটা জানি না, আমার ক্ষেত্রে একেকটা গান মাথায় ঘুরতে শুরু করে, আর আশেপাশের সকল কিছুর সাথে সেটার একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায়। যেমন, আজকে! আজ দুপুরে (কিংবা সকালেও হতে পারে) মাথায় একটা বাক্য এসেছিল। কোথাও লিখে রেখেছিলাম, ‘সেই জানালা দিয়ে রাত্রিবেলা চাঁদ নেমে আসতো।’ এই একটা বাক্যই। এবং কী সুন্দর, এই বাক্যটার সাথেই গানটার সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেল। Everybody had a hard year, everybody had a good time …। ধরো, জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি কোনো এক সময়। বেশ গরম, মাথার ওপরে ঘোরলাগা বনবন শব্দে ফ্যানটা ঘুরছে। মাত্রই সন্ধ্যে পার হয়ে রাত নেমেছে। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে, কিছুক্ষণ আগে জেগে উঠেছো। ঘুম ভেঙে দেখলে, ঘরটা এলোমেলো, ঘুটঘুটে অন্ধকার। খোলা জানালা দিয়ে চাঁদ নেমে আসছে। তার আলো পড়ছে তোমার চোখেমুখে, সারা বিছানায়… ঠিক সেই মুহূর্তে একটা মানুষের কেমন অনুভূতি হয়? আমি জানি না। তবে দ...

ব্রহ্মার পুত্র, ব্রহ্মার কন্যা

ছবি
[আরিফের জন্য মৃদু সতর্কবার্তা। ফারহার জন্য ছয় নম্বর বিপৎসংকেত। বাকিদের সমস্যা নেই।] গতকাল ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম। গাধাটা ক’দিন ধরে বেশ মনটন খারাপ করে বসে আছে। ভাবলাম, আমরা দু-একজন আড্ডা দিয়ে আসলে ভালো কিছু হতে পারে। পরিকল্পনা ছিল যে, গতকাল আমি যাব, আর আজ-কাল আরেকজন যাবে। প্রায়ই পাগল দুটোকে যখন বিদায় দিয়ে বাসে তুলে দেই, তখন মনে হয়, দুম করে বাসে উঠে ময়মনসিংহ চলে যেতে পারলে মন্দ হত না। কে জানে, সেকারণেই গতকাল বাসে চড়ে বসতে এত বেশি ভালো লেগেছিল কিনা! এবং ময়মনসিংহ নেমেও কেন যেন বড় ভালো লাগলো। অটোতে করে নিজেই শহরের রাস্তাগুলো খুঁজতে গিয়ে পুরো শহরটাকে হঠাৎ করেই খুব বেশি আপন মনে হল—যতখানি আগে কখনই হয়নি। এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই, অটোতে বসে ঠিক করলাম যে, রিয়াকে ফোন দিয়ে বলবো, খুব খিদে পেয়েছে, যেন দুপুরে একটু খেতে দেয়! টাউন হলে এসে নেমে পড়লাম। শীতের দুপুরে মোড়টা দেখতে বড় সুন্দর লাগছিল। ওপাশে একটা হলদে রঙের দোতলা বাড়ি আছে—সেটার গায়ে যখন রোদ পড়ে—মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। আমি কলেজের পাশের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে রিয়াকে ফোন দিলাম। গাধাটা রীতিমত কানফাটানো একটা চেঁচানি দিল, ‘আল্লাহ, ভাইয়া ...

এলোকথন (মৃগশিরা ২৪:১)

ছবি
শীতটুকু নামেমাত্র হলেও, এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে। আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারি না, কারণ কাক-না-ডাকা ভোরে উঠে যখন কাক-ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে আমাকে একটা দিন পার করতে হয়, এবং এরপর আরামবাগের বিপরীতে প্রচণ্ড চায়ের তৃষ্ণা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, এবং এরও পর, আমাকে যথাক্রমে ও বিপরীতক্রমে হাঁটতে ও দাঁড়াতে হয়—তখন আমি ব্যাখ্যা করতে পারি না—কেন এইসব শীতের রাতে (কিংবা সন্ধ্যায়) আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে। ভাগ্যে তিনি ছিলেন। নয়তো হয়তো জোর গলায় এটুকুও বলতে পারতাম না যে, আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে। বড়জোর ‘ক্যাঙ্কা লাগতিসে গে বা’ বলেই থেমে যেতে হত, কিংবা আরেকটু স্পষ্ট করে বললে—আমাকে থমকে যেতে হত, প্রচণ্ড শক্তিতে নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করতাম, আমি চিৎকার করতে চাইতাম, এবং শেষপর্যন্ত, ‘ক্যাঙ্কা জানি লাগতিসে’-তে এসেই থমকে যেতাম। এই মৃত্যুর কারণ কি কেবল এই যে, আমরা ক্লান্তিটুকু, আমাদের বিষণ্নতাটুকু রাখার জন্য একটা ছায়া খুঁজে বেড়াই? কিংবা, ছায়ার আশ্রয়টুকুতে আসার ঠিক পরমুহূর্তেই কি এক ধরনের বিষণ্নতাবোধ আমাদের আক্রান্ত করে? আমাদের ক্লান্ত, ক্লান্ত করে? আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারি না, কা...

চেঁচামেচি দিবস

ছবি
অনেক অনেককাল আগে, একটা সুন্দর দিন ছিল। যেদিন কিছু হয়নি। যেদিন কেউ জানত না যে, দিনটা সুন্দর ছিল। অথচ দিনটা সুন্দর ছিল। অনেক অনেককাল আগে, এক বিকেলে আমি বসে ছিলাম। এমনিই বসে ছিলাম। সেই বিকেলে কিছু হয়নি। কিছু যে হয়নি তার প্রমাণ, সেই বিকেলের কথা কেউ জানে না। অসংখ্য শব্দেভর্তি আমার ডায়েরিটাও তার খোঁজ জানে না। বিকেলটা সুন্দর ছিল। আজ থেকে অন্তত এক কোটি বছর আগে, অচেনা নম্বর থেকে একটা ফোন এসেছিল। এমনিই ফোন এসেছিল, কোন কারণ ছিল না। কারণ যে ছিল না তার প্রমাণ, সেই যদি ফোন আমি না ধরতাম, তবে গোটা জীবনে দ্বিতীয়বার আর সেই ফোন আসত না। তাতে কিছু এসে যেত না, কারণ আমি কখনই জানতে পারতাম না সেই ফোনের কথা—যেটা জীবনে একবার আসে। কিছু এসে যেত না বটে। যেই মানুষটা সারাটা জীবন একটা অন্ধকার ঘরে কাটিয়ে দেয়, সে নিশ্চয়ই আলোর অভাবে হাঁসফাঁস করে মরবে না? সুতরাং, স্পষ্টতই আমি বেঁচে থাকতাম। জোর গলায় ঘোষণা দিতাম, আমি পৃথিবীর স্পর্শ চিনি। এবং প্রাণভরে শব্দগুলো শুনতাম। বলতাম, they slither while they pass, they slip away across the universe. অথচ আমি জানতে পারতাম না—ইউনিভার্স দেখা আমার বাকিই রয়ে গে...

অন্তর্গত বিস্ময় – ২

ছবি
“God is a concept—by which we measure our pain.” কথাটা জন লেনন বলেছিলেন, কোন এক গানে। থুড়ি, ঠিক ‘কোন এক গানে’ বলাটাও ঠিক হচ্ছে না, কারণ এটা যথেষ্ট বিখ্যাত একটা গান। সত্যি বলতে কী, এই গানের কথা যে আমি কতবার করে মানুষজনকে বলেছি, বলতে বলতে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছি—কতবার এমন হয়েছে—আমি নিজেও জানি না। এবং ঠিক এই কথাটাই আমার লেখার কথা সপ্তাহদুয়েক আগে। আবারও রিয়ার বকা খেয়ে লিখতে বসলাম—এদ্দিন বাদে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত, কারণ যুক্তি বলে, রিয়ার বকায় কাজ হওয়ার কথা না। বিশেষ করে, নভেম্বরের এই ভুতুড়ে রাতে কোনক্রমেই হওয়ার কথা না। তবে কিনা, যুক্তির উপরে আরও কিছু একটা বাস করে, কাজেই যখন লিখতে বসার কথা না—ঠিক তখনই আমার মনে হয়, ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার মনে পড়ে আরিফের অমর উক্তি—‘দামি লেখা পড়তে গেলে আমি নিশ্চয়ই পাবলিক লাইব্রেরিতেই যেতাম? আপনার কাছে সস্তা লেখাই পড়তে চাইসি, সুতরাং প্লিজ, লেখেন।’ আমি যে একেবারেই লিখছি না—ব্যাপারটা এমনও না। বছরের মাঝখানে ডায়েরি লেখা প্রায় ছেড়ে দিয়েও এই বছর প্রায় বিয়াল্লিশ হাজার শব্দের ডায়েরি লিখে ফেলেছি, ডিসেম্বর শেষ হতে হতে বোধকরি তা পঞ্চাশে গিয়েই ঠেকবে—এটাই...

অন্তর্গত বিস্ময় – ১

ছবি
এক. হতে পারে, নভেম্বরের এই সময়টা মানুষের মধ্যে খানিকটা হলেও সাইকিডেলিয়া এনে দেয়। অবশ্য, ‘সাইকিডেলিয়া’ শব্দটা বলা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না, এটা অর্থ অনেকভাবেই করা যায়। এর চেয়ে অনুভূতিটাকে ‘পরাবাস্তব’ ডাকলেই বরং ভালো শোনায়। হেমন্তকাল না এটা? হেমন্তে যেই রহস্যময়তা আছে, এবং যেই রহস্যটুকু আছে হেমন্তকে পুনর্জন্ম দেয়া কবির ভেতরে—সেই রহস্য সম্ভবত আর কোথাও নেই। আমি মাঝেমধ্যেই ভাবি, জীবনানন্দ যদি এভাবে হেমন্তকে নতুন করে জন্ম দিয়ে না যেতেন, আমরা কীভাবে নিজেদেরকে ব্যাখ্যা করতাম? একটা ফর্সা চাদর, ফর্সা বিছানা, জানালার পাশের টেবিলটায় বসে, ঠিক রাত আটটায় দ্বাদশীর আলো দেখে যেই অনুভূতিটা হত—সেটার কারণ আমরা কীভাবে খুঁজে পেতাম? আমার ধারণা, আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম, স্ট্যাটের মাঠে দিশেহারা হয়ে বসে থাকতাম, আমাদের হাত-পা কাঁপতে থাকত, আরও একবার মহাখালী থেকে বাসে উঠতে গিয়ে আমরা কেবল শূন্যতাই দেখতাম (অর্থাৎ ঢেউটুকু দেখতাম না)। এবং তিনি ছিলেন। তিনি ছিলেন, তাঁর ট্রাঙ্কটুকু ছিল—বড় সৌভাগ্য আমাদের—হেমন্তের মধ্যিখানে এসে আমরা আবিষ্কার করতে পারি যে, “জানি—তবু জানি নারীর হৃদয়—প্রেম—শি...

এ্যালানার গল্প এবং একটুখানি বরিশাল

ছবি
আমার সমবয়সী বন্ধুদের মধ্যে কেমন যেন একটা অভিভাবক-টাইপ ভাব থাকে। অবশ্য, সমবয়সী বা আছে ক’জন। আঙুলে গুণে ফেলা যাবে, এবং সেটা হাতের আঙুল ছাড়িয়ে পা পর্যন্ত যাওয়ার কথা না। তাদের একজনের নাম এ্যালানা। এবার বরিশালে গিয়ে এ্যালানার সাথে দেখা করেছিলাম, অনেকদিন পর। এবং কোন এক অদ্ভুত কারণে, বরিশালের গল্প অনেকের কাছে করলেও এ্যালানা মেয়েটার প্রসঙ্গ আসেনি। ঘুরেফিরে আমরা বরিশালের স্কুলগুলো, সেখান থেকে কীর্তনখোলা, সেখান থেকে আবারও বরিশালের রাস্তা—এই গল্পগুলোতেই ফিরে এসেছি, কিন্তু এ্যালানার কথা বলার সময়টুকু হয়নি। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, ওদের শহরে গিয়ে মেয়েটাকে ভড়কে দিব। কাজেই আগে থেকে কিছু বলিনি। ভুলেও যাচ্ছিলাম অবশ্য ওর কথা। আমরা যেই সকালে বরিশালের মাটিতে পা রাখলাম, সেদিন বড় বৃষ্টি হচ্ছিল। লঞ্চে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম সবাই। কাজকর্ম করছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল আরেকটু কাজ করানোর, কিন্তু রাত তিনটার দিকে বাকি তিনজন বিদ্রোহ ঘোষণা করল। এখন নাকি এক কাপ চা না হলে কোনভাবেই চলছে না। কাজেই আমরা কেবিন ছেড়ে বাইরে বের হলাম, এবং আবিষ্কার করলাম মোটামুটি সারা লঞ্চ চুপচাপ, শান্ত, সবাই গভীর ঘুমে। কাজেই চ...

এলোকথন (কৃত্তিকা ২৪:২)

ছবি
এই পৃথিবীর কেবল দুটো মানুষের সাথে আমি ঝগড়া করি।  কিছুক্ষণ আগে ব্যাপারটা খেয়াল করলাম। এমনিই।  আবার হয়তোবা, এমনিই না। হয়তোবা কোন কারণ ছিল ব্যাপারটা খেয়াল করার পেছনে।  ক্লাস বন্ধ, বাসাতেই বসে ছিলাম সকাল থেকে। দুপুরে কী মনে করে শহীদুল জহিরের বইটা হাতে নিলাম।  এই বইটার কথা আমি প্রথম শুনি একটা ভুতুড়ে দিনে, ময়মনসিংহের একটা মানুষের কাছ থেকে। এবং আমি এই বইটা পড়া শুরু করি আরেক ভুতুড়ে দিনে, জ্বরের প্রবল ঘোরে বিভ্রান্ত হয়ে বসে থাকার দিনে।  এ কথাটা অদ্ভুত যে, আমি কেন আজকেই এই বইটা শুরু করলাম, একটা সাধারণ দিনেও এই বই অসাধারণ বিভ্রম তৈরি করতে পারত, আর আজকের দিনটা বেছে বেছে আলাদাভাবে সুররিয়েলিস্টিক একটা দিন।  এবং এ কথাটাও অদ্ভুত যে, বইয়ের প্রথম গল্পটাই শুরু হল ভূতের গলি থেকে, যে গলির একটা মানুষ ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য রীতিমত খেপে আছে।  হতে পারত না অন্যকিছু? হতে পারত গল্পটা শুরু হয়েছে একেবারেই নিরস কোন জায়গা থেকে, এই ধর, শ্যামলী থেকেই, আর এরপর, হতেই পারত, শ্যামলীর সেই মানুষটা খেপে আছে ততোধিক সাধারণ কোন জায়গায় যাওয়ার জন্য, হয়তোবা সেটা গাজীপুর—...

এলোকথন (কৃত্তিকা ২৪:১)

ছবি
এক. কিছুক্ষণ আগে একটা হুমকি পেয়েছি। চুপচাপ বসে ছিলাম। হঠাৎ করেই ধমকটা খেলাম। আজ রাতেই কিছু একটা না লিখলে আমি নাকি শেষ! শ’খানেক মাইল দূরে বসে এত সহজে হুমকি দেয়া যায়—কে জানতো। কী আর করা। যা মনে আসে, লিখে ফেলি। সমস্যাটা হল যে, মনে অনেক কিছুই আসে। সেই যে, words are flowing out like endless rain into a paper cup. কাজেই লিখতে গিয়ে বারবার দ্বিধায় পড়তে হয় আমাকে। গত কয়েক সপ্তাহে খুব অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমার আফসোস হচ্ছে যে, আবারও ডায়েরি লেখার অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে আমার। যদি থাকতো, তবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে যেত। এমনও তো দিন গেছে, লেখার তোড়ে রীতিমত আমার হাত কাঁপতে শুরু করেছে—শব্দগুলো যেন মাথাতেও আনার দরকার হচ্ছে না—চিন্তা থেকে সরাসরি আমার আঙুলে চলে যাচ্ছে, আর আমি লিখে ফেলছি। কে জানে, হয়তো সামনেই অমন দিন আবার আসবে। আজ অথৈ ফোন দিয়েছিল, অনেকদিন পর। প্রায় প্রতিদিনই ভাবি, পিচ্চিটাকে ফোন দিব। সেই কবে একবার সঞ্জীবের একটা গান শুনতে বলেছিল, সেই কথাটুকুর উত্তর না দিয়ে আমি যে ডুব দিলাম, আর খোঁজ নেই। অথৈ ফোন দিয়ে প্রথমে এই কথাটাই জিজ্ঞেস করল, আমি কোথায় হারিয়ে গেছি। আম...

এলোকথন (অশ্বিনী ২৪:৪)

ছবি
আজ বেশ ক’দিন হল, আব্বু বাসায় নেই। আব্বু বাইরে গেলে আমরা বড় একটা টের পাই না। ছোটবেলা থেকেই এমনটা হয়ে আসছে। ব্যাপারটা মোটেও আশ্চর্যের না, কারণ আব্বু যখন দেশে থাকে, তখনও তার সাথে খুব একটা দেখা হয়—এমনটা দাবি করা যাচ্ছে না। একই বাসায়, একইসাথে থেকে কেন আব্বুর সাথে নিয়মিত দেখা হয় না—এটাই বরং আশ্চর্যের। সেই ছোটবেলা থেকে দেখি, সকালবেলা উঠে আব্বু দৌঁড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়, অফিস আছে। কিছু মানুষ থাকে না, কাজপাগল ধরনের? অমন একটা মানুষ। অফিসে গিয়ে সে জ্যান্ত মানুষের মতই কাজ করতে থাকে, ঝিমায় না। বরং আমি আস্তে হাঁটলেই উল্টো ধমক দেয়, ‘আই এ্যাম সিক্সটি ইয়ার্স ওল্ড, আমি পারলে তুমি পারবা না কেন?’ সক্কালবেলা বেরিয়ে ফেরে বিকেলবেলা। (ঘুমটা কি বেশি পেয়েছে? আসলে আব্বু তো ফেরে রাত এগারোটায়। একটা ঘোরের মধ্যে লিখতে গিয়ে ‘বিকেল’ লিখে ফেললাম।) যাকগে, আব্বু ফেরে রাত এগারোটায়। এবং তখনও জ্যান্ত মানুষের মতই বাসায় ঢোকে, আর যদি বাসায় দাদু থাকে, তবে তো কথাই নেই, কে বলবে রাত এগারোটার বেশি বাজে, এবং এই বাসায় সবচেয়ে ছোট মানুষটার বয়স বাইশ? আব্বু আর দাদু মিলেই ছোটদের অভাব পূরণ করে দেয়—রীতিমত উৎফুল্ল ভঙ্গিতে দুজন...

এলোকথন (অশ্বিনী ২৪:৩)

ছবি
লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে আজ। আজকাল লেখার ইচ্ছেটা আসে ছাড়াছাড়াভাবে। ব্যাপারটা মোটেও অস্বাভাবিক না, কারণ আমি কাজ করতে করতে মারা যাচ্ছি। জানি না, হয়তো সাতসকালে উঠে দৌঁড়ে বাসা থেকে বের হই। ভার্সিটিতে যতক্ষণ পারি ক্লাসনোট তুলি। যেদিন টানা পাঁচটা ক্লাস থাকে সেদিন শেষ ক্লাসটুকুতে সবাই কলাপ্‌স করে। মাথা আছড়ে বেঞ্চে পড়ে যায়। আমি চারদিকে তাকাই, দেখি সবাই মরে যাচ্ছে, অথবা গেছে, সেই কবে! কনকের মত দু-একজন তবু বেঁচে থাকে, নিলয়ের মত দু-একটা পাগল এখনো স্বপ্ন দেখে, তবু বাকিরা তো মরে গেছে। আমি নিজেও কলাপ্‌স করি কখনো, বেঞ্চে মাথা রেখে আক্ষরিক অর্থেই স্বপ্ন দেখি। গত কিছুদিন যেসব স্বপ্ন দেখেছি—তার মাথামুণ্ডু কিছুই নেই। একদিন দেখলাম, মুনির স্যার এসে কংগ্রেসের এক্সপেরিমেন্টের জিনিসপত্র সব ফেলে দিয়েছেন। আমার বড় ভয় হয়, আমি একদিন এসব স্বপ্ন দেখে ক্লাসেই চিৎকার করে জেগে উঠবো। কায়কোবাদ স্যার এসে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে বলবেন, ‘ইউ আর সো স্মার্ট, ক্লাসে ঘুমোলেই তোমার পড়া হয়ে যায় তাই না?’ ক্লাস থেকে বেরিয়ে দৌঁড়ে অফিসে যাই, এবং আবারও কাজ শুরু করে দেই। আগ্রহের সাথেই করি, সুতরাং কাজের মাঝে ডুবে থাকলে টের পাই না চারপা...